সোমবার, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

রাজনৈতিক দোকানের শেষ নেই

নিত্যনতুন গজিয়ে উঠছে আওয়ামী লীগের ভুঁইফোড় সংগঠন

রফিকুল ইসলাম রনি

রাজনৈতিক দোকানের শেষ নেই

জানুয়ারি মাসে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এম এ আজিজের মৃত্যুর পর শোক প্রকাশ করে ব্যানার ছাপিয়ে আলোচনায় আসে ‘অভিভাবক লীগ’। এর আগে এ সংগঠনের নাম শোনেনি কেউ। শুধু অভিভাবক লীগই না, গত জানুয়ারিতে গঠন করা হয়েছে ‘ইতিহাস চর্চা লীগ’ ও ‘অধিকার আদায় লীগ’ নামে দুটি সংগঠন। এ ছাড়া ‘আওয়ামী লীগ’, ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য’, ‘মুক্তিযোদ্ধা’ নাম ব্যবহার করে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে রাজনৈতিক চাঁদাবাজির দোকান। অধিকাংশ সংগঠনের ঠিকানা বঙ্গবন্ধু এভিনিউ লেখা থাকলেও সেখানে এসব সংগঠনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে এদের স্বীকৃতি না থাকলেও ২০০৮ সালের আগে এ ধরনের প্রায় ১২-১৪টি ভুঁইফোড় সংগঠনের কার্যক্রম ছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর হঠাৎ করে বৃদ্ধি পেতে থাকে ‘রাজনৈতিক দোকান’। পর্যায়ক্রমে এর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কোনোভাবেই লাগাম টানা যাচ্ছে না চাঁদাবাজির দোকান হিসেবে পরিচিত এসব ভুঁইফোড় সংগঠনের। বর্তমানে দুই থেকে আড়াই শতাধিক সংগঠন রয়েছে আওয়ামী ঘরানার। রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব নামসর্বস্ব সংগঠন গড়ে উঠছে মূলত উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে। আর এ শাস্তিহীনতার সুযোগ নিয়ে এর অপব্যবহার করছে সুবিধাভোগী মহল। তারা বলছেন, এসব ভুঁইফোড় সংগঠন মূলত লিফলেট, ভিজিটিং কার্ড, ব্যানার-ফেস্টুন-সর্বস্ব। অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, নিবন্ধন, গঠনতন্ত্র ও কার্যালয় কিছুই নেই। সংগঠনের নেতা-কর্মীও হাতে গোনা। তাদের দাবি, তারা আওয়ামী লীগের অঙ্গ বা ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন। দলের জন্য তারা কাজ করেন। বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেন। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এবং সরকারের উন্নয়নের সহযোগী। সংগঠনগুলো বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা সভার আয়োজন করে থাকে। সংগঠনের নেতা মূলত এক থেকে তিন জন। এতে আওয়ামী লীগের এমপি, মন্ত্রিসভার বর্তমান ও সাবেক সদস্য এবং চটকদার ও সময়োপযোগী বক্তব্যে যারা সব সময় মিডিয়ায় থাকেন তাদের অতিথি করা হয়। মিডিয়ায় কভারেজ পেতে আগ্রহী ক্ষমতাসীন দলের এমন নেতাদের কাছ থেকে অনুষ্ঠানের খরচসহ মোটা অঙ্কের চাঁদা নেওয়া হয়। যে বেশি পরিমাণে চাঁদা দেন তিনি অনুষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া চাঁদার অঙ্কের পরিমাণের সঙ্গে মিল রেখে অনুষ্ঠানের অতিথিদের পাশে বসানো হয়। রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাব, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইডিইবি), ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, ফটোজার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, শিল্পকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রায় প্রতিদিনই এসব দোকান বসে। অনুষ্ঠান শেষ করেই মূল উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ চলে যান সচিবালয়ে। বিভিন্ন তদবির নিয়ে ঘুরে বেড়ান মন্ত্রী থেকে সচিবের দফতরে। আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা মনে করেন, এসব ভুঁইফোড় ও নামসর্বস্ব সংগঠনের উদ্যোক্তারা দলের নাম ভাঙিয়ে ‘আগাছা’, ‘পরগাছা’ হয়ে ‘স্বার্থ হাসিলের দোকান’ খুলে বসেছেন। এগুলো আওয়ামী লীগের কোনো সংগঠন নয়, এসব যারা করছেন তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তারা। আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, কিছু নামসর্বস্ব সংগঠনের খবর শুনি। তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো সম্পর্ক নেই। এগুলোর লাগাম টানার চেষ্টা চলছে। প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দলের কিছু সমর্থক নামসর্বস্ব কিছু সংগঠন গড়ে তুলে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছেন। ক্ষমতায় আসার পর এসব সংগঠন গজিয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, এটাও সত্যি আমাদের কোনো কোনো নেতা এসব সংগঠনের অনুষ্ঠানে যান। সেখানে বক্তব্য দিয়ে তাদের জিইয়ে রাখেন; যা সত্যিই দুঃখজনক। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ উপসম্পাদক দেবুকুমার ভট্টাচার্য ২৬ জানুয়ারি তার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে এসব ভুঁইফোড় সংগঠন বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘লীগ ব্যবহার করে সৃষ্ট ভুঁইফোড় সংগঠনগুলোর পরিচালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি এবং সংগঠনগুলো বন্ধ করাও জরুরি। পাশাপাশি এটাও ভাবা দরকার এসব ভুঁইফোড় সংগঠনের উপদেষ্টা কারা এবং এসব ভুঁইফোড় সংগঠনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে প্রধান অতিথি হন কারা? এদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া উচিত কিনা? লীগ ব্যবহার করে নতুন নতুন সংগঠন খোলার সাহস এবং উৎসাহ আসে কোথা থেকে বা এর পেছনে প্রধান কারণ কী, এটাও ভাবা দরকার।’ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের অভিভাবক (ভারপ্রাপ্ত সভাপতি) এম এ আজিজের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে আলোচনায় আসা ‘অভিভাবক লীগ’-এর উদ্যোক্তা কে বা কারা, তাদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তবে ‘ইতিহাস চর্চা লীগ’-এর নেতাকে পাওয়া গেছে। তিনি যাত্রাবাড়ী এলাকার মুহম্মদ আল ফয়সাল। তিনি বলেন, মুক্তিযুুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিএনপি যেভাবে মিথ্যাচার শুরু করেছে, সে মিথ্যাচারের প্রতিবাদ জানাতে এ সংগঠন যাত্রা শুরু করেছে। তিনি যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বলে জানান। দুই বছর আগে ফয়সাল মুন্সী প্রতিষ্ঠা করেন শিশুলীগ। এ সংগঠনের নামে একটি লোগোও বানানো হয়েছে। যেখানে রয়েছে অর্ধসূর্যের আলোর বিকিরণের ওপর একটি ফিডার এবং শিশুদের খেলনা-জাতীয় কিছু ছবি। এরপর লেখা ‘বাংলাদেশ শিশু-কিশোর লীগ’। প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাই শিশু লীগ করবে বলে জানান সংগঠনের উদ্যোক্তা ফয়সাল মুন্সী। গত বছর ‘আওয়ামী উদ্যোক্তা লীগ’ নামে আরও একটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করেছে। এর সমন্বয়কারী জসীম উদ্দিন রুমান। রুমান জানান, আওয়ামী লীগের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে এ সংগঠন গড়ে তুলেছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর