সোমবার, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

আশিয়ান সিটির নতুন প্রতারণার ফাঁদ

নিজস্ব প্রতিবেদক

আশিয়ান সিটির নতুন প্রতারণার ফাঁদ

সুপ্রিম কোর্ট আশিয়ান সিটিকে অবৈধ ঘোষণা সত্ত্বেও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ‘আশিয়ান শীতল ছায়া’ নামে নতুন এক ভুয়া প্রকল্পের ফাঁদ পেতেছে প্রতিষ্ঠানটি। অনুমোদনহীন এ প্রকল্পের মাধ্যমে অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যেতে ওই এলাকায় অস্ত্রধারী ক্যাডার বাহিনী নামিয়েছেন প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা। ক্যাডার বাহিনীর লোকজন স্থানীয়দের কাছ থেকে জোর করে জমি দখল, অন্যের জমিতে ভুয়া সাইনবোর্ড টানিয়ে চটকদার বিজ্ঞাপন, জমির মালিককে ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ নানা অপতত্পরতা চালিয়ে যাচ্ছে।  

অভিযোগ রয়েছে, শীতল ছায়া প্রকল্পের জন্য অবৈধ আশিয়ান প্রকল্পের পরিচালক নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া তার ভাই সাইফুল ইসলামকে নিয়ে ভাড়া করা মাস্তান ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় স্থানীয়দের সম্পত্তি দখলের চেষ্টা করছেন। এর আগে নিরীহ লোকজনকে আকৃষ্ট করতে তারা ব্যবহার করেছেন চলচ্চিত্র নায়ক রিয়াজকে। এরই মধ্যে নায়ক রিয়াজের খ্যাতির খপ্পরে পড়ে আশিয়ান সিটির প্লট কিনে সর্বস্বান্ত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। জানা গেছে, এখন আশিয়ানের সঙ্গে নাই বললেও একসময় সবকিছুতে ছিলেন। ইতালিসহ বিশ্বের অনেক দেশে গিয়ে আশিয়ানের নামে মানুষকে প্রতারিত করেছেন। তার আকর্ষণে যারা প্লট কিনেছেন তারা কিছুই বুঝে পাননি।  

অন্যদিকে আশিয়ানের প্রতারণা অব্যাহত রয়েছে। তারা নিত্য নতুন কায়দায় প্রতারণা অব্যাহত রেখেছে। জানা গেছে, সর্বোচ্চ আদালত ঢাকার আশিয়ান সিটি প্রকল্প অবৈধ ঘোষণার পর হাজার হাজার ক্রেতাকে প্লট বুঝিয়ে দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। ফলে জনগণের চাপ সামাল দিতে না পেরে রূপগঞ্জের কায়েতপাড়ায় নতুন করে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে তারা। স্থানীয় নিরীহ কৃষকদের জমি দখলে নিতে অনুমোদনহীন আশিয়ান শীতল ছায়া প্রকল্প এলাকায় অস্ত্রধারী ক্যাডাররা বর্তমানে মহড়া দিচ্ছে। ফলে ওই এলাকার মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। অস্ত্রধারীদের হুমকির মুখে এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন কৃষক এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। গত এক সপ্তাহে রূপগঞ্জ থানায় অন্তত ১০টি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) দায়ের করেছেন ভুক্তভোগীরা। অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা সাধারণ ক্রেতাদের কাছে ওই ভুয়া প্রকল্পের বৈধতা প্রমাণ করতে জমি না কিনে ভাড়া করা জমিতে সাইনবোর্ড লাগিয়ে চটকদার বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। এ কাজে লোকমান, তাহের, রজ্জব আলী, শফি, নাছির, আবু মেম্বারসহ বেশ কয়েকজন স্থানীয় জমির দালাল সহযোগিতা করছেন। অবৈধ শীতলছায়া কর্তৃপক্ষ ভাড়া করা ওইসব জমি নিজেদের দাবি করে ক্রেতাদের কাছে প্লট বিক্রির চেষ্টা করছেন। আবার এই সাইনবোর্ডের দৌরাত্ম্যেই নিরীহ লোকজন ও সরকারের জমি দখল করে নেওয়ার চেষ্টা করছে। কেউ প্রতিবাদ করতে গেলেই তাদের প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ অনেকে বিষয়টি টের পেয়ে ক্রেতাদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। স্থানীয়রা জানান, তাদের এলাকার ইউপি সদস্য মোশারফ হোসেন বলেছেন, আশিয়ান শীতল ছায়া থেকে জমির মালিক ও প্লট ক্রেতাদের সাবধান হতে হবে। তা না হলে সবাইকে প্রতারণার শিকার হতে হবে।  

জানা গেছে, বর্তমানে প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা কায়েতপাড়া, ছনেরটেক, নগরপাড়া, সুতিরপাড়, মাঝিনা, মাঝিনা নদীর পাড়, কোটাপাড়া, তালাশকুর, হরিনা, মাইনাবো, ইছাখালী, বরুনা, বড়ালু, পাড়াগাঁও, বিরুলিয়া, দেলপাড়া, নয়ামাটি, দক্ষিণপাড়াসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় জবরদখলে মেতে উঠেছে। তাদের ভাড়া করা ক্যাডার বাহিনী ওই এলাকাগুলোতে নিয়মিত মহড়া দিচ্ছে। সেখানে অস্ত্র দিয়ে ভয় দেখিয়ে নিরীহ মানুষের জমি রেজিস্ট্রি করে নেওয়ার পাঁয়তারা করছে প্রকল্প পরিচালক নজরুল ইসলাম ও তার লোকজন। প্রতিষ্ঠানটির দখলযজ্ঞ বন্ধ করতে এবং প্রতারণার হাত থেকে জনগণকে রক্ষা করতে সরকারের সহযোগিতা কামনা করছেন এলাকাবাসী। এ ব্যাপারে রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহমুদুল ইসলাম বলেন, স্থানীয়ভাবে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে বেশ কয়েকটি অস্ত্রধারী ক্যাডার বাহিনী আশিয়ান শীতল ছায়া আবাসন প্রকল্পের পক্ষে কায়েতপাড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় মহড়া দিচ্ছে। এদের দ্রুত গ্রেফতারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এস এম মাহফুজুর রহমান বলেন, আশিয়ান শীতল ছায়া সরকারি জমি দখলের পাঁয়তারা করছে বলে আমরা খবর পেয়েছি। সরকারি খাসজমি চিহ্নিত করে তা উপজেলা প্রশাসনের আওতায় আনা হচ্ছে। আশিয়ান শীতল ছায়াকে কোনোভাবে সরকারি জমি দখল করতে দেওয়া হবে না। জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট এলাকায় আশিয়ান সিটির সন্ত্রাসীরা স্থানীয় জমির মালিক ও কৃষকদের ওপর হামলা এবং অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিনের পাইপ বসানোর চেষ্টার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ সভা ও  মানববন্ধন পালন করেছেন এলাকাবাসী। নদীতে পাইপ বসিয়ে বালু তুলে একের পর এক জমি জবরদখল করার কাজে বাধা দেওয়ায় প্রকল্পের ভাড়া করা দালালরা রামদা, চাপাতিসহ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জমি মালিকদের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটিয়েছে। এ ব্যাপারে উপজলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহজাহান ভূঁইয়া বলেন, আমার জানা মতে রূপগঞ্জে আশিয়ান শীতল ছায়া নামে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। কোথাও যদি আশিয়ান এমন সাইনবোর্ড লাগিয়ে সাধারণ মানুষের জমি জোরপূর্বক দখলে নেওয়ার চেষ্টা করে, তবে তাদের বিরুদ্ধে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া জনগণও দখলবাজ আবাসন প্রকল্পকে ছাড় দেবে না।  

এদিকে স্থানীয় সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজী (বীরপ্রতীক) বলেন, সাধারণ জনগণের জমি দখলের চেষ্টা করাটা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। জমি দখলের চেষ্টা চালানো হলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তা প্রতিহত করা হবে। এ ছাড়া দখলবাজি করলে ওই আবাসন প্রকল্পের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এর আগেও আশিয়ানের নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে জমি দখলের অসংখ্য অভিযোগ ওঠে এবং এসব অভিযোগের প্রমাণও পাওয়া যায়। আর এ কাজে ব্যবহার করা হয় নায়ক রিয়াজকে। তিনি প্রথমে আশিয়ানের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর এবং পরে পরিচালক ও সর্বশেষ প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ফেসভ্যালু থাকায় প্রবাসী অনেক গ্রাহকই রিয়াজের মাধ্যমে জমি কেনার টাকা দিয়ে প্রতারিত হন। সম্প্রতি এই নায়ক আশিয়ান সিটি ছাড়ার পর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই ২০০৬ সালে উত্তরার উত্তরখান ও দক্ষিণখান এলাকায় আশিয়ান সিটি প্রকল্পের কাজ শুরু করে। প্রকল্পের জন্য যে পরিমাণ জায়গা প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি জমি নিয়ে কার্যক্রম শুরু করা ও অনুমোদন না নেওয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে জনস্বার্থে আইন ও সালিশ কেন্দ্র, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন, ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্ট বাংলাদেশ, নিজেরা করি ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন ২০১২ সালের ২২ ডিসেম্বর রিট করে। এরপর বিভিন্ন আইন ও বিচারিক প্রক্রিয়া পার হয়ে ২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারি উত্তরার আশিয়ান সিটি প্রকল্প অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। অভিযোগ রয়েছে, বর্তমানে ওই এলাকায় সরকারি জায়গাজমি ছাড়াও সাধারণ মানুষজনের জমি জবরদখল করে বানানো হচ্ছে হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, হাসপাতাল নির্মাণের কথা বলে আশিয়ান সিটির নজরুল ইসলাম ২২টি পরিবারের ১৩ বিঘা ১৯ শতাংশ জমি দখল করে নেন। হাসপাতালকে পুঁজি করে এ ১৩ বিঘা ১৯ শতাংশ জমি ছাড়াও আশপাশের আরও বহু নিরীহ পরিবারের জমি দখল করে নিচ্ছেন তিনি। রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই নজরুল হাসপাতাল নির্মাণের সব আয়োজন সম্পন্ন করেছেন। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করে বলেন, হাসপাতালের সেবামূলক কর্মকাণ্ডের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে আশিয়ান সিটি মূলত প্লট ব্যবসার আরেকটি ধান্ধা করার চেষ্টা করছে।

সর্বশেষ খবর