মঙ্গলবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

দ্বৈত নাগরিকত্বে আতঙ্ক

জনপ্রতিনিধি ও আমলাদের অনেকে দুই দেশের নাগরিক

নিজস্ব প্রতিবেদক

দ্বৈত নাগরিকত্বে আতঙ্ক

দ্বৈত নাগরিকত্বে নিষেধাজ্ঞা আতঙ্ক তৈরি করেছে জনপ্রতিনিধি ও আমলাদের মধ্যে। গত সপ্তাহে মন্ত্রিসভায় নতুন নাগরিকত্ব আইনের খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদনের পর থেকেই এ আতঙ্কের শুরু। এ আইনের কারণে সংসদ সদস্য, সিভিল ও পুলিশ সার্ভিসসহ অন্যান্য চাকরিতে থাকা কোনো সরকারি কর্মকর্তা বিদেশের কোনো দেশের নাগরিকত্ব নিতে পারবেন না। পাশাপাশি দ্বৈত নাগরিকত্বধারী কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধি হতে পারবেন না। এমনকি দ্বৈত নাগরিকরা রাজনৈতিক দল করার অধিকারও হারাতে যাচ্ছেন নতুন এ আইনে। অথচ বর্তমানে বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধি এবং আমলার রয়েছে দ্বৈত নাগরিকত্ব। ইতিমধ্যে নেওয়া এসব দ্বৈত নাগরিকত্বের তথ্য ফাঁস হলে তারা পদ হারাতে পারেন। আবার নতুন আইনে মিথ্যা তথ্য বা তথ্য গোপনের জন্য কারাদণ্ডের বিধানও রাখা হয়েছে।

সূত্রমতে, বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন-২০১৬ অনুমোদনের সঙ্গে সঙ্গেই একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদে থাকা দ্বৈত নাগরিকদের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেছে। কোন দলের কত জন সংসদ সদস্যের দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে সে তালিকা প্রণয়নের কাজ করছে সংস্থাগুলো। অবশ্য কোনো কোনো সংস্থার কাছে আগে থেকেই দ্বৈত নাগরিকত্বধারী এমপি ও সরকারি কর্মকর্তাদের তথ্য ছিল। তারা এখন সে তালিকা হালনাগাদ করছে। সে তালিকায় থাকা এমপি ও আমলাদের বাংলাদেশের বাইরে কানাডা, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে। আরেক গ্রুপ মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম  তৈরি করেছে। অবশ্য এর বাইরে ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলোর নাগরিকত্বও নিয়ে রেখেছেন কেউ কেউ। আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর পদ ছেড়ে রাজনীতি থেকে বিদায় নেওয়া সোহেল তাজ তার তখনকার সহকর্মীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে অনেকের মুখোশ দেখে ফেলেছি। বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করলে, হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেব। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও এমপিদের কমপক্ষে ১০-১২ জন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ব্রিটেনের নাগরিক।’ এ সংখ্যা দিন দিন আরও বাড়ার তথ্যই পেয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ জানিয়েছে, বিদ্যমান ‘দি সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট-১৯৫১’ ও ‘দি বাংলাদেশ সিটিজেনশিপ টেমপোরারি প্রভিশন্স অর্ডার-১৯৭২’-এর অসম্পূর্ণতার কারণে নাগরিকত্বসম্পৃক্ত সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হচ্ছিল না। এ কারণে সাম্প্রতিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে আগের দুই আইন এক করে নতুন আইন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। নতুন আইনে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু সুপ্রিমকোর্টে বিচারক, জাতীয় সংসদের সদস্য, সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি, সশস্ত্র বাহিনী বা প্রজাতন্ত্রের কোনো বেসামরিক পদে নিয়োজিত ব্যক্তিরা দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পারবেন না। আর দ্বৈত নাগরিকরা স্থানীয় সরকার নির্বাচন, জাতীয় সংসদের সদস্যপদে নির্বাচন, রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন, বিচারকসহ প্রজাতন্ত্রের কোনো কাজে নিয়োগলাভ বা কোনো রাজনৈতিক সংগঠন করতে পারবেন না। পাশাপাশি মিথ্যা বা বিকৃত তথ্য প্রদান বা তথ্য গোপন করে এ আইনের অধীনে নাগরিকত্বসংক্রান্ত অপরাধের জন্য অপরাধী অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। শাস্তির বিধান আরও বাড়াতে আইনমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি কমিটি করার সিদ্ধান্তও নিয়েছে মন্ত্রিসভা। প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রদত্ত তথ্যানুসারে, বাংলাদেশের রাজনীতিক ও উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের একটি অংশ কানাডায় মূল্যবান বাড়ি কিনেছেন। সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ ও রাজনীতিকদের বেগম অর্থাৎ স্ত্রীদের নামে থাকা এসব বাড়ির আধিক্য সেখানে এতটাই বেশি যে, একটি রাস্তারই নাম হয়েছে বেগমগঞ্জ। পাশের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রতি নগদ অর্থে দামি বাড়ি কেনা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মার্কিন সরকার যে তদন্ত শুরু করেছে তার মধ্যে বাংলাদেশি রাজনীতিক ও আমলা থাকার তথ্য সে দেশের গণমাধ্যমেই এসেছে। তারা এসব বড় অঙ্কের বিনিয়োগের মাধ্যমে সম্পত্তি কেনার আগে-পরে নিয়েছেন দ্বৈত নাগরিকত্ব। কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ায় এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি। গোয়েন্দাসূত্রের খবর, নতুন আইনের খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার পর আতঙ্কে পড়েছেন ইতিমধ্যেই দ্বৈত নাগরিকত্ব নেওয়া এমপিরা। কারণ, দ্বৈত নাগরিকত্বের ফলে এমপি পদই শুধু চলে যাবে না, তাদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারও শেষ হয়ে যাবে। আবার উচ্চাকাঙ্ক্ষী আমলারা বিত্তবৈভব অর্জনের পর রাজনীতির মাধ্যমে আরও বড় ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার স্বপ্ন দেখেই চাকরি জীবনে দলীয় লেজুড়বৃত্তি করেন। অবৈধ পথে আয় করা সম্পদ বিদেশে বিনিয়োগ করে দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়েছেন এমন একাধিক আমলা বর্তমানে চাকরিতেও আছেন। অবৈধ সম্পদ ও পরিবারের সুরক্ষার পাশাপাশি বিপক্ষ রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকাকালে নির্বিঘ্নে বিদেশে কাটানোই তাদের মূল উদ্দেশ্য। এখন নতুন আইনে তাদের সেই স্বপ্ন ভঙ্গ হয় কিনা তা নিয়েই রয়েছে আতঙ্ক।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আগেও সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব নেওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু মাঝে তা তুলে দেওয়া হয়েছিল। এখন নিশ্চয়ই কোনো শুভবুদ্ধি থেকেই সরকার নতুন করে জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এ উদ্যোগের সফলতা কামনা করি। তবে উদ্যোগ বা আইনের সফলতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রয়োগের পাশাপাশি সময়োপযোগী পর্যালোচনার প্রয়োজন আছে।’

সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যারা বাংলাদেশের নাগরিকত্বের বাইরে দ্বিতীয় বা তৃতীয় দেশের নাগরিকত্বের দিকে আগ্রহী তাদের চেয়ে বাংলাদেশিরাই জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য বেশি যোগ্য। দ্বৈত নাগরিকদের বাংলাদেশের বাইরে অন্য আরেকটি দেশের প্রতি অঙ্গীকার থাকে। তাই দ্বৈত নাগরিককে জনপ্রতিনিধি, সাংবিধানিক পদ বা প্রজাতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে পুরোপুরি নিশ্চিন্ত থাকা যায় না। তাই সরকারের এ পদক্ষেপ পুরোপুরি যৌক্তিক এবং এটাই হওয়া উচিত। তবে সরকারের কিছু শীর্ষ কর্মকর্তা ও এমপি দ্বৈত নাগরিক বলে বিভিন্ন সময়ে শোনা যায়। সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। ব্যত্যয় পাওয়া গেলে নতুন নাগরিকত্ব আইন পাসের পর তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থাও নিতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর