বুধবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

সরকারি হাসপাতাল আল্লাহ ভরসা

সরকারি হাসপাতাল আল্লাহ ভরসা

হৃদরোগ হাসপাতালের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বারান্দায় গাদাগাদি করে রোগীদের করুণ অবস্থান (বামে)। পঙ্গু হাসপাতালে জরুরি বিভাগে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো ও খালি গায়ে আড়াই ঘণ্টা ধরে পড়ে ছিল এই মরদেহটি। ছবি সোমবার রাতের —রোহেত রাজীব

দেশের সরকারি হাসপাতালগুলো যেন শুধুই আল্লাহ ভরসা। বেডের অভাবে হৃদরোগীদের রাখা হয় ফ্লোরে। জরুরি বিভাগে রাতে থাকে না কেউ। রোগী এলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকে। দেখার কেউ নেই। গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতালে যন্ত্রপাতি নষ্ট দীর্ঘদিন। এ অবস্থায় রোগী এবং স্বজনরা থাকেন অসহায়। বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে প্রতিবেদন করেছেন— জুলকার নাইন, মাহমুদ আজহার, গোলাম রাব্বানী, জিন্নাতুন নূর ও রফিকুল ইসলাম রনি

একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা শনিবার ভোররাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন। পরিবারের দুই নারী সদস্য তাকে নিয়ে গেলেন রাজধানীর মিরপুরের হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। রোগীকে আইসিইউতে নেওয়ার জন্য বলা হলো। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউতে নেওয়ার পর দেখা গেল সেখানে ইতিমধ্যেই ৩০-৪০ জন রোগী অবস্থান করছেন। তাদের অর্ধেকও পাননি চিকিৎসার বেড। শুয়ে আছেন আইসিইউর মেঝেতে গাদাগাদি করে। সাবেক সরকারের কর্মকর্তা রোগী তখনো বেশ সাবলীলভাবেই কথা বলছেন। এমন সময় দেওয়া হলো ইনজেকশন। ইনজেকশন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগী ঘুমিয়ে যাবেন বলে জানানো হলো এবং হলোও তাই। কিন্তু সেই ঘুম আর ভাঙল না। এর আগেই এসেছিলেন হাসপাতালের শীর্ষ কর্তা। উচ্চপদের এই চিকিৎসক রোগীকে পর্যবেক্ষণও করেছেন। কিন্তু তিনি কী দেখলেন বা পর্যবেক্ষণ করে কী ধরনের ব্যবস্থাই বা নিলেন তা রোগীর পাশে দাঁড়িয়েও বোঝা গেল না। তবে তিনি যখন চলাচল করছিলেন তখন মুহুর্মুহু শোনা যাচ্ছিল বাঁশির শব্দ। পরিচালক সাহেবের যাওয়া-আসার জন্য সিকিউরিটিদের যত তোড়জোড় হতভাগা রোগী ও স্বজনদের ওপরই। দেখা গেল, রোগী হাসপাতালে আসা থেকে শুরু করে লাশ মর্গ থেকে বের করা পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই দিতে হচ্ছে টাকা। স্ট্রেচার থেকে বালিশ— সব কিছুতেই দিতে হচ্ছে ৫০-২০০ টাকা। এর কোনোটিই সরকারের কোষাগারের জন্য নয়, সবই ঘুষ। আইসিইউতে দাঁড়িয়েই জানা গেল, হৃদরোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় সরকারি হাসপাতালে হার্টের রোগীর জন্য অপরিহার্য ‘অক্সিজেন মাস্ক’ প্রয়োজনীয় সংখ্যায় নেই। যেখানে আইসিইউতেই রোগী আছেন ৩০-৪০ জন, সেখানে মাস্ক আছে মাত্র ২০টি। তা-ও অতি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আনুকূল্যে পাওয়া। সব দেখেশুনে আইসিইউতে থাকা এক রোগীর খেদোক্তি, ‘সরকারি হাসপাতালে, আল্লাহই ভরসা’। সেদিনের এই চিত্র দেখার পর সোমবার মধ্যরাত থেকে গতকাল মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে রোগীদের অশেষ ভোগান্তি দেখা যায়। দেখা গেল, হাসপাতালের কেউ দায়িত্ব নিয়ে রোগীর কাছে যান না, দ্বারে দ্বারে ঘুরে রোগীকেই জানতে হয় কোথায় যেতে হবে। সরেজমিন দেখা যায়, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের প্রবেশমুখে রোগীদের তথ্য প্রদান ও টিকিট কাউন্টারের সামনে সোমবার রাত ২টায় গিয়ে দেখা যায় একজন গার্ড সেখানে বসে ঝিমুচ্ছেন। ফলে হাসপাতালে এসে চিকিৎসাসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য পেতে রোগীদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। অন্যদিকে, নিয়মিত চিকিৎসার জন্য রোগীর অতিরিক্ত চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ভোররাতে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ৬ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, একজন রোগীর জন্য একটি বেডে রোগী ও তার স্বজন মিলে দু-তিন জন গাদাগাদি করে থাকছেন। এ তো গেল বেডের কথা। হাসপাতালের মেঝেতেও থাকতে হচ্ছে রোগীকে। শীতের রাতে চাদর বিছিয়ে রোগীর সঙ্গে স্বজনরাও কোনোরকম গাদাগাদি করে শুয়ে আছেন। আর যারা জায়গা পাচ্ছেন না তারা দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। একই অবস্থা হাসপাতালের ৭ নম্বর ওয়ার্ডেরও। সবচেয়ে করুণ অবস্থা মহিলা ওয়ার্ডের। রোগীর অতিরিক্ত চাপে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের স্বল্পপরিসরের বারান্দাটিকেও ওয়ার্ড বানানো হয়েছে। শীতের রাতে বারান্দার ফাঁক গলে বাতাস প্রবেশ করায় রোগীর সঙ্গে থাকা তার ছোট শিশুটিও গুটিসুটি মেরে শুয়ে ছিল। নোংরা, অস্বাস্থ্যকর ও দুর্গন্ধময় সেই পরিবেশে এর সঙ্গে বাড়তি ছিল মশার উপদ্রবও। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, মশার হাত থেকে বাঁচতে মহিলা ওয়ার্ডে লাগানো হয়েছে তীব্র দুর্গন্ধযুক্ত নিম্নমানের ক্ষতিকর কয়েল; যা সদ্য জন্ম নেওয়া নবজাতক এবং তার মা উভয়ের স্বাস্থ্যের জন্যই ক্ষতিকর। সোমবার ভোররাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে (ঢামেক) প্রবেশ করে হাসপাতালের নিচতলার এক্স-রে রুমের সামনে একটি ট্রলিতে একজন বৃদ্ধকে প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। এ সময় সেই বৃদ্ধের পাশে ছিলেন হাসপাতালের এক ওয়ার্ডবয়। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লোকটি খিলগাঁও থেকে এসেছেন এক ঘণ্টা আগে। তিনি স্ট্রোক করেছেন। হাসপাতালের সাত তলায় বৃদ্ধের ছেলে তাকে চিকিৎসক দেখিয়েছেন। সেই চিকিৎসক আবার তাকে এক তলায় এক্স-রে করাতে পাঠিয়েছেন। অগত্যা বাবাকে নিয়ে ছেলের ছোটাছুটি শুরু হয়। এরই মধ্যে সেই বৃদ্ধের অবস্থার আরও অবনতি হয়। বেশ কিছু সময় পর ছেলে বাবার ট্রলির কাছে আসেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘এক ঘণ্টা হলো বাবাকে নিয়ে এখানে এসেছি। কোথায় এবং কার কাছে গিয়ে সাহায্য পাব তার কিছুই বুঝতে পারছি না। বাবাকে একা রেখে নিজেই দৌড়াদৌড়ি করে এদিক-সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছি। এত বড় হাসপাতাল কিন্তু সাহায্য করার কেউ নেই!’ শান্তিনগর থেকে দুই বছর বয়সী এক কন্যার এক্স-রে করাতে ঢামেক হাসপাতালে এসে ভোগান্তিতে পড়েন এক অভিভাবক। তিনি জানান, এক্স-রে রুমে গিয়ে দেখেন রুমটি খালি। অনেকক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় এই প্রতিবেদক রোগী সেজে ভিতরে গিয়ে ডাকাডাকির পর বয়সে তরুণ এক টেকনোলজিস্টের দেখা পান। কিন্তু সেখানকার আরেক মেডিকেল টেকনোলজিস্ট তখন ঘুমাচ্ছিলেন। তাকে ঘুম থেকে ডাকার পর করা হয় এক্স-রে। হাসপাতালের নিচতলায় হাতের বামে নিউরোসার্জারি বিভাগে সোমবার দিবাগত রাত আড়াইটায় গিয়ে কোনো নার্স বা তথ্য প্রদানকারীকে পাওয়া যায়নি। রেজিস্ট্রার টেবিলের ওপর রেজিস্টার খাতা, এর পাশে কিছু ওষুধপথ্য দেখা গেলেও এ সময় সেখানে দায়িত্ব পালন করতে কাউকে পাওয়া যায়নি। এদিকে ঢামেক হাসপাতালে আসা রোগীর চাপ বেশি হওয়ায় এ হাসপাতালের সিঁড়ির নিচে ও তার দুই পাশে, প্রতিটি ওয়ার্ডের মেঝেতে এবং হাসপাতালের করিডোরের মেঝেতেও রোগী ও স্বজনদের শুয়ে থাকতে দেখা যায়। হাসপাতালে পর্যাপ্ত ওয়ার্ডবয় না থাকায় সেখানকার আনসার সদস্যরাই রোগীর ট্রলি ঠেলে নিয়ে ছোটাছুটি করেন। দেখা গেছে, ৪ নম্বর ওয়ার্ডে ৪৫ জনের ধারণক্ষমতা। সেখানে বারান্দা, ফ্লোরসহ বিভিন্ন স্থানে গাদাগাদি করে শুয়ে আছেন চার শতাধিক রোগী ও স্বজন। ওয়ার্ডে বিড়াল ঘোরাফেরা করছে। বাথরুমগুলো খুবই নোংরা। তেলাপোকা, মশা, মাছিসহ ছারপোকার কামড়ে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে রোগীদের। স্বজনদের অনেকেই জেগে আছেন। অধিকাংশ রোগীই শ্বাসকষ্টের কিংবা স্ট্রোক করে এ ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছেন।

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ভায়রা বলে কথা : জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে রাত তখন ১টা ২০ মিনিট। জরুরি বিভাগের সামনে দুজন মহিলা দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারা এসেছেন ময়মনসিংহ সদর হাসপাতাল থেকে। তাদের সঙ্গে আসা ৫০ বছরের ওলিউল্লাহর হৃপিণ্ডের একটি অংশে ব্লক ধরা পড়েছে। ময়মনসিংহ সদর হাসপাতাল থেকে তাদের ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। মোতালেবের স্ত্রীর কাছে তার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে নিয়ে জানা যায়, হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে আসার আগে তারা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করে এসেছেন। কারণ স্বাস্থ্যমন্ত্রী তাদের আত্মীয় হন। ওলিউল্লাহর ব্যাপারে আগে থেকেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে সব কিছু বলে রাখা ছিল। ফলে অন্য রোগীদের যেখানে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নেমে ট্রলি পেতে অপেক্ষা করতে হয় কিংবা চিকিৎসককে দেখানোর জন্য সিরিয়ালে দাঁড়াতে হয় এই রোগীর ক্ষেত্রে দেখা গেল ব্যতিক্রম ঘটনা। তড়িত্গতিতে ময়মনসিংহ থেকে আসা এই রোগীর চিকিৎসা শুরু হলো। এই রোগীকে নিয়ে হাসপাতালের কর্মচারীদের ব্যস্ততাও ছিল চোখে পড়ার মতো। যেখানে অন্য রোগীদের চিকিৎসা পাওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়। মোতালেবের ক্ষেত্রে তার প্রয়োজন পড়েনি। মোতালেবের স্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিদিন বলেন, ‘আমার স্বামী স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ভায়রা। আমরা এখানে আসার আগে তার সঙ্গে যোগাযোগ কইরা আসছি। আমাদের জন্য আগে থেইক্যা সব ঠিক করা আছে।’ হাসপাতালে আসার পর কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, কোনো সমস্যাই হয়নি। আসার সাথে সাথেই তারে ডাক্তার দেখাইছি।’ এরই মধ্যে কথা শেষ না হতেই জরুরি বিভাগ থেকে বের হয়ে আসেন মোতালেব। তাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে উপরে ভর্তি করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ সময় তাকে ঘিরে হাসপাতালের দু-এক জন কর্মচারীর ব্যস্ততাও ছিল চোখে পড়ার মতো।

সর্বশেষ খবর