বুধবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

‘দেখুম না, যা পারেন করেন’

মঙ্গলবার রাত ১টা। হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে শাসকষ্টের এক রোগী কাতরাচ্ছেন। ওয়ার্ডে নেই কোনো চিকিৎসক। দুজন নার্স ও দুজন ওয়ার্ডবয় তখন ব্যস্ত সিট-বাণিজ্য নিয়ে। ধারণক্ষমতার চেয়েও চার পাঁচগুণ বেশি  রোগী। শাসকষ্টের ওই রোগীর সঙ্গে ছিলেন না কোনো স্বজন। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে এগিয়ে আসেন পাশের এক রোগীর স্বজন কৌশিক। তিনি কয়েক দফা নার্সের সঙ্গে যোগাযোগ করলে দুর্ব্যবহার করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। পরে তিনি ওয়ার্ডবয় জাহিদ ও রুহুলকে অনুরোধ করেন শ্বাসকষ্টের রোগীকে দেখতে। সিট-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত ওয়ার্ডবয় জাহিদ ধমক দিয়ে বলেন, ‘দেখুম না, ব্যস্ত আছি। যা পারেন করেন।’

পরে কৌশিক ওই রোগীকে নিয়ে দ্রুত নিচতলায় ইমারজেন্সিতে যান। চিকিৎসককে দেখিয়ে কয়েকটি টেস্টও করান তিনি। এ নিয়ে কথা বলতে হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষে যান কৌশিক। সেখানে একজন চিকিৎসক তাকে থামিয়ে দেন। পরে হাসপাতালের অব্যবস্থাপনার কথা পরিচালককে জানান ওই যুবক। এ সময় পরিচালক বলেন, ‘ধারণক্ষমতার বাইরে রোগী। আমাদের কিছু করার নেই। সরকারকে এ বিষয়ে বলেন।’

মঙ্গলবার গভীর রাতে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ৪ নম্বর ওয়ার্ডে ধারণক্ষমতা ৪৫ জনের। সেখানে বারান্দা, মেঝেসহ বিভিন্ন স্থানে গাদাগাদি করে শুয়ে আছেন চার শতাধিক রোগী ও তাদের স্বজনেরা। ওয়ার্ডে বিড়াল ঘোরাফেরা করছে। বাথরুমগুলো খুবই নোংরা। তেলাপোকা, মশা, মাছিসহ ছারপোকার কামড়ে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে রোগীদের। স্বজনদের অনেকেই জেগে আছেন। অধিকাংশ রোগীই শাসকষ্ট নিয়ে কিংবা স্ট্রোক করে এ ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছেন। পাবনা থেকে আসা ৭০ বছরের এক রোগী বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে অভিযোগ করেন, শাসকষ্টে তিনি সোমবার দুপুুরে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। একবার এক চিকিৎসক এসেছিলেন। তবে মিনিটখানেক থাকার পর চলে গেছেন। এরপর আর চিকিৎসক, নার্স কিংবা ওয়ার্ডবয় কারও দেখা তিনি পাননি। শ্বাস নিতে তার কষ্ট হচ্ছে।

জামালপুর থেকে আসা হার্টের আরেক রোগী বলেন, ‘ভর্তি হয়েছি। নার্স আর ওয়ার্ডবয়দের দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ। তাদের ধারেকাছে ঘেঁষা যায় না।’ নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা এক রোগীর স্বজন অভিযোগ করেন, ভর্তির পর রক্ত টেস্ট করাতে ৫০০ টাকা নেওয়া হয়েছে। পরে দ্রুত রিপোর্ট পেতে আরও ৩০০ টাকা দিতে হয়েছে তাকে। অন্যথায় দু-এক দিন পর রিপোর্ট দেওয়ার কথা তাকে জানানো হয়। তার অভিযোগ, ভর্তির পর সিটের জন্য ওয়ার্ডবয়দের ২০০ থেকে ৩০০ টাকা দিতে হয় এখানে। এর পরও ওয়ার্ডবয়-নার্সরা রোগীদের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করেন। রাত সাড়ে ১২টার দিকে একই অবস্থা দেখা গেছে পঙ্গু হাসপাতালে গিয়েও। সেখানেও ইমারজেন্সিতে কর্তব্যরত নার্সদের বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ আনেন রোগীরা। সাধন দেবনাথ নামে এক রোগীকে ভর্তি না হতে পেরে মেঝেতে বিছানা পেতে শুয়ে থাকতে দেখা গেছে। ই/এফ ওয়ার্ডে গিয়ে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, রোগীদের কেউ কেউ জেগে আছেন। তবে চিকিৎসক-নার্স কেউ নেই। নার্সেস স্টেশন ফাঁকা। পাশেই একটি কক্ষে কয়েকজন নার্স  মশারি টানিয়ে ঘুমাচ্ছেন। পটুয়াখালী থেকে আসা এক রোগী বলেন, রাত ১০টার পর থেকে কোনো চিকিৎসক কিংবা নার্সের দেখা পান না তারা। বড় কোনো সমস্যায় পড়লে ইমারজেন্সি থেকে চিকিৎসকদের ডেকে আনা হয়। নার্সরাও ঘুমান। ডাকতে গেলে তারা বিরক্তি বোধ করেন। রাত আড়াইটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, পুরুষ ওয়ার্ডে গাদাগাদি করে রোগী ও স্বজনরা ঘুমাচ্ছেন। অস্বাস্থ্যকর এক পরিবেশ। নেই কোনো চিকিৎসক কিংবা নার্স। নেই ওয়ার্ডবয়ও। শরীয়তপুর থেকে আসা এক রোগীর স্বজন জানান, সেখানে ওয়ার্ডবয়দের দৌরাত্ম্যে অনেক সময় চিকিৎসকরাও অসহায়। রোগীদের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করা হয়। ভর্তির পরও প্রতি বেডের জন্য আলাদা করে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা করে দিতে হয়। না দিলে বেড থেকে রোগীকে নামিয়ে দেওয়া হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর