বুধবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

লাশ পড়ে থাকল আড়াই ঘণ্টা

সোমবার রাত ১০টা। জাতীয় অর্থোপেডিক্স হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল) অবজারভেশন রুমে ট্রলির ওপরে খালি গায়ে পড়ে আছে এক হতভাগ্যের নিথর দেহ। মুখে লাগানো অক্সিজেন মাস্ক। বাম হাতে চলছে  স্যালাইনও। এর মধ্যে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নতুন নতুন রোগীও আসছেন। সবার দৃষ্টি সেই নিথর দেহের দিকে। রাত প্রায় ১১টা। অবজারভেশন রুমে আনা হয় এক হার্টের রোগীকে। স্বজন রোগীকে সেই দেহের দিকে তাকাতে বার বার নিষেধ করছেন। কিন্তু এমন দৃশ্য দেখে ওই রোগী কান্নাকাটি শুরু করে দেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে রোগী স্বজনদের বলেন, ‘আমারে কই আনলা, এটা হাসপাতাল না কসাইখানা। তোমরা আমারে অন্য কোথাও নিয়ে যাও।’     

এই নিথর দেহকে ঘিরে অবজারভেশন রুমের অন্য রোগীর স্বজনদের মধ্যে নানা কানাঘুষা চলছিল। প্রায় এক ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করেও বোঝার উপায় ছিল না সেই নিথর দেহের মানুষটি বেঁচে আছেন কিনা। এ প্রতিবেদক কৌতূহলবশত অন্য রোগীর স্বজনদের কাছে জানতে চান এই রোগী কার? কোনো ডাক্তার তাকে দেখছেন না কেন? শীতের মধ্যেও তার গায়ে কোনো কাপড় নেই কেন? তখন অন্য এক রোগীর স্বজন উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানান, ‘রাত সাড়ে ৯টার দিকে লোকটা মইরা গ্যাছে। তারে এহানেই ফ্যাল্লা রাখছে। একটু কাপড় দিয়েও ডাইক্কা দেয়নি।’ তবে তার মুখে অক্সিজেন মাস্ক ও স্যালাইন পুশ করা হচ্ছে কেন? জানতে চাইলে দায়িত্বরত ডাক্তাররা কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। এরপর রাত সাড়ে ১১টায় একজন ওয়ার্ডবয় এসে মুখের অক্সিজেন ও হাতের স্যালাইন খুলে দেন। রাত ১২টার কিছু পর আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে লাশ নিয়ে চলে যান রোগীর স্বজনরা। জানা গেছে, রাজধানীর রূপনগর এলাকায় সোমবার রাতে বাসার লিফট ছিঁড়ে পড়ে গিয়ে মারাত্মক আহত হন। পরে তাকে জাতীয় অর্থপেডিক্স হাসপাতালে (পঙ্গু) ভর্তি করা হয়। ওয়ার্ডবয়রা তার এক্সরেও করান। তারা এই রোগীর স্বজনদের বলেন, তার মাথায় আঘাত লেগেছে। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু তাত্ক্ষণিক কোনো ডাক্তার তারা পাননি। পরে রাত সাড়ে ৯টার দিকে মারা যান এই হতভাগ্য রোগী। এদিকে অবজারভেশন রুমে ট্রলির উপরে আড়াই ঘণ্টা নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখে হাসপাতালে আসা রোগীর স্বজনরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। লাশের জন্য আলাদা ঘর রয়েছে, এখানে নানা ধরনের রোগী আসে, সবাই মৃত মানুষ সহ্য করতে পারেন না। তাদের কথা বিবেচনা করেও তো কর্তৃপক্ষ ওই লাশের জন্য একটু জায়গা দিতে পারত। সোমবার রাত ১টা ১০ মিনিট। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তির জন্য আনা হয় আবদুর রহিমকে। কিন্তু ভর্তির দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষ করার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। মৃত্যুর আগে এই রোগী অ্যাম্বুলেন্সের ট্রলি থেকে মেঝেতে পড়ে গেলেও হাসপাতালের কোনো নার্স বা ওয়ার্ডবয় রোগীকে ধরে তুলতেও এগিয়ে আসেননি। ভর্তির আগে স্বজনরা ডাক্তারের জন্য এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছিলেন। কিন্তু কোনো ডাক্তারও তাকে দেখেননি। পরে তার মৃত্যুর সার্টিফিকেট নিয়ে দেখা দেয় আর এক বিড়ম্বনা। ভর্তি কার্যক্রম শেষ হওয়ার আগেই তার মৃত্যু হওয়ায় স্বজনরা লাশ দিয়ে পড়েছেন বিপাকে। হাসপাতালের লোকজন লাশ নিতেও দিচ্ছে না। পরে মৃত ব্যক্তির ইসিজি করার পরামর্শ দেন সংশ্লিষ্ট নার্সরা। এটি মাত্র একটি দৃশ্য। এমন অসংখ্য দৃশ্য সরেজমিন গিয়ে দেখে গেছে এই হাসপাতালে। এখানে কোনো রোগী ভর্তি করতে আনলে ঘাটে ঘাটে ওয়ার্ডবয়দের ২০০ থেকে ৫০০ টাকা দিতে হয়। তা ছাড়া কোনো রোগীর ট্রলিতে হাত লাগান না কোনো নার্স, ওয়ার্ডবয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর