রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় করা ১ লাখ ১৭ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট আটকের মামলার আসামিদের জামিনে জালিয়াতির রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। এ মামলার সব কাগজপত্র ঠিক রেখে জব্দকৃত ইয়াবা ট্যাবলেটের সংখ্যা পরিবর্তন করে শুধু ১৭৭ পিস দেখিয়ে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে হাইকোর্ট থেকে জামিন নেওয়া হয়েছে। সেই জামিন আবেদনের ভুয়া কাগজপত্রে জজ আদালতের নকল সিলের পাশাপাশি আইনজীবীদেরও স্বাক্ষর রয়েছে। এ ছাড়া যাত্রাবাড়ী থানায় করা ১ হাজার ৫০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধারের আরেকটি মামলায় পরিমাণ কমিয়ে শুধু ৮০ পিস ইয়াবা উদ্ধারের ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে জামিন নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি এসব ঘটনায় জালিয়াতির বিষয়টি রাষ্ট্রপক্ষ থেকে উচ্চ আদালতের নজরে আনা হলে আসামিদের জামিন বাতিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ঘটনা-১. গত বছরের ১৬ আগস্ট যাত্রাবাড়ী এলাকার সম্রাট কমিউনিটি সেন্টারের সামনে একটি নোহা মাইক্রোবাস (ঢাকা মেট্রো চ-৫১-৬৭৪১) থেকে গ্যাস সিলিন্ডারের মধ্যে বিশেষ কায়দায় ১ লাখ ১৭ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করে গোয়েন্দা পুলিশ। এ ঘটনায় গোয়েন্দা পুলিশের এসআই মনির হোসেন মোল্লা বাদী হয়ে ১৭ আগস্ট মামলা করেন। যাত্রাবাড়ী থানার মামলা নম্বর-৪৮(৮)১৫। মামলার আসামিরা হলেন কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার নয়নপুরের মৃত আবুল খায়েরের ছেলে ইয়ামিন (২৪), গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার নাওরাদোলা এলাকার রেন্টু শেখের ছেলে সাহেদ শেখ (২২), গাজীপুরের জয়দেবপুর উপজেলার ডগরি এলাকার রাজু আহম্মেদের ছেলে তুষার (২৪), চট্টগ্রামের ডবলমুরিং উপজেলার বেপারীপাড়ার মৃত নজির মাঝির ছেলে আবদুর রশিদ ওরফে বগা সেলিম (৩৫) ও কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার পশ্চিম লেদা আলীখালী এলাকার হাজী আবুল কাশেমের ছেলে শামসুল হুদা ওরফে শামসুল ইসলাম। পরে এ ঘটনার তদন্ত করে গত বছরের ১৮ নভেম্বর পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। অভিযোগপত্রে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে নিজস্ব মাইক্রোবাসযোগে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা মহানগরীর আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় পাইকারি এবং খুচরা ইয়াবা ট্যাবলেটের ব্যবসা করতেন। বহুদিন পর্যন্ত তারা এভাবে অবৈধ ইয়াবা ট্যাবলেটের ব্যবসা করে আসছেন। মামলার নথিসূত্রে জানা গেছে, এ মামলায় ১ লাখ ১৭ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেটের পরিবর্তে ১৭৭ পিস ইয়াবা দেখিয়ে ভুয়া কগজপত্র তৈরি করে গত বছরের ৭ ডিসেম্বর হাইকোর্ট থেকে আসামি ইয়ামিন, শাহেদ শেখ, তুষার আহম্মেদ জামিন নিয়েছেন। যার ফৌ: বি: মামলা নম্বর-৪৮৩৯৭/১৫। পরে এ বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হলে আসামিদের জামিন বাতিল করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
ঘটনা-২. গত বছরের ৩০ নভেম্বর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে শ্যামলী পরিবহনের ঢাকা মেট্রো ব—১৪-৬৭৩০ নম্বরের একটি এসি বাস থেকে ১ হাজার ৫০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করে গোয়েন্দা পুলিশ। এ সময় শ্যামালী পরিবহন গাড়ির ড্রাইভার আবদুর রাজ্জাক ও সুপারভাইজার আল-মামুনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে এ ঘটনায় সাব ইন্সপেক্টর ফরহাদ হোসেন বাদী হয়ে দুজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন (নম্বর ৫৭(১১)১৫)। পরে এ দুই আসামির জামিনের জন্য হাইকোর্টে আবেদন করা হয়; যার ক্রিমিনাল মিস কেস নম্বর-৭৩৯/১৬। জামিন আবেদনে মামলার জব্দকৃত আলামত ১ হাজার ৫০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট হলেও তার কাগজপত্র জালিয়াতি করে দেখানো হয়েছে ৮০ পিস ইয়াবার মামলা। এর মধ্যে এক আসামির কাছে ৫০ পিস ও আরেক আসামির কাছে ৩০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এ মামলাটি ১ হাজার ৫০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট আটকের। এর মধ্যে গাড়ির ড্রাইভার আবদুর রাজ্জাকের কাছ থেকে ১ হাজার ও সুপারভাইজার আল-মামুনের কাছ থেকে ৫০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয় বলা আছে। এ মামলার আসামিরা কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার আগেই প্রতারণার মাধ্যমে জামিন নেওয়ার বিষয়টি ধরা পড়ে যায়। এর ফলে আসামিরা আর কারাগার থেকে মুক্তি পাননি। শুধু ওপরের এ দুটো ঘটনাই নয়, এভাবে অনেক আসামি ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে আদালত থেকে জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে এখন লাপাত্তা। তবে পুলিশের খাতায় এসব আসামি দুর্ধর্ষ। এ রকম বিরল জালিয়াতির ঘটনায় আদালতপাড়ায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে।এ বিষয়ে আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের লিগ্যাল এডুকেশন কমিটির চেয়ারম্যান ও ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি কাজী মো. নজীব উল্লাহ হিরু জানান, মাঝেমধ্যে এ ধরনের অভিযোগ শোনা যায়। এর সঙ্গে একটি সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত। জালিয়াতি আসামি একা করতে পারেন না। তাই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া উচিত। সুপ্রিমকোর্টের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার (বিচার ও প্রশাসন) মো. সাব্বির ফয়েজ জানান, জালিয়াতি করে আদালত থেকে জামিন নেওয়ার ঘটনা খুবই দুঃখজনক। এ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। তবে সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে সম্প্রতি ‘বেইল কনফারমেশন’ নামে একটি সফটওয়্যার যুক্ত করা হয়েছে। কেউ জামিন পেলে ওই সফটওয়্যারের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিচারিক আদালতকে অবহিত করা হয়।