বৃহস্পতিবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

তদন্ত হয়, চার্জশিটের দেখা নেই

সাখাওয়াত কাওসার

তদন্ত হয়, চার্জশিটের দেখা নেই

রাজধানীসহ সারা দেশে অনেক চাঞ্চল্যকর মামলার তদন্তে পুলিশ অগ্রগতির কথা বললেও চার্জশিটের দেখা মিলছে না। কবে চার্জশিট দেওয়া হবে, এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলাও হচ্ছে না। এরই মধ্যে বারবার বদল হচ্ছে তদন্ত কর্মকর্তা। পুলিশ বলছে, সব মামলাই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত শেষ হওয়া মাত্রই আদালতে চার্জশিট জমা দেওয়া হবে। তবে ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যরা বলছেন, গুরুত্বপূর্ণ মামলা বললেও তদন্তে অবহেলার বিষয়টি স্পষ্ট। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগও করছেন না। অনেক মামলায় কোনো আসামি গ্রেফতার না হওয়ায় ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিরাজ করছে ক্ষোভ ও হতাশা। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বারবার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হলে মামলার তদন্ত গতি শ্লথ হয়ে যায়। সব ধরনের প্রমাণ হাতে পাওয়ার পরও আদালতে যথাযথভাবে চার্জশিট উপস্থাপন না হলে মামলার বিচারিক ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টির আশঙ্কা থেকে যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, নন পুলিশিং কাজ দিয়েই বেশি সময় ব্যস্ত রাখা হয় পুলিশকে। অনেক সময় তদন্তে প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহলের হস্তক্ষেপ আসে। সর্বোপরি বারবার তদন্ত কর্মকর্তার পরিবর্তন মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে।

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব রাজাবাজারে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরোয়ার-মেহেরুন রুনি নৃশংসভাবে খুন হন। হত্যাকাণ্ডের চার বছর পেরিয়ে গেলেও তদন্তের কোনো কিনারা হয়নি। তবে এরই মধ্যে মামলা থানা-ডিবি হয়ে র‌্যাবে। কেবল র‌্যাবেই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছে তিনবার। বর্তমানে তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সহকারী পুলিশ সুপার মহিউদ্দীন আহমেদ। ২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট রাজধানীর রাজাবাজারে মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী খুন হওয়ার পর হত্যা মামলাটি প্রথমে থানা হয়ে ডিবিতে যায়। সর্বশেষ প্রায় এক বছর ধরে সিআইডিতে। সিআইডিতেও দুই দফা তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছে। এর আগে ডিবিতে দুই দফায় তদন্ত কর্মকর্তা বদল করা হয়েছিল। জানা যায়, এখন পর্যন্ত তদন্তে কোনো অগ্রগতি আসেনি। এ তো মাত্র দুটি উদাহরণ। চাঞ্চল্যকর অনেক মামলারই তদন্তের দশা এই দুই ঘটনার মতোই। আটকে আছে চার্জশিট।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ব্লগার অভিজিত্ রায়কে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় গত বছর ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে। ওই ঘটনায় তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা নিজেও গুরুতর আহত হন। অভিজিত্ হত্যা ঘটনায় উগ্রপন্থি ফারাবীসহ আটজনকে পুলিশ গ্রেফতার করে। তাদের কয়েক দফায় রিমান্ডে নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য আদায় করা সম্ভব হয়নি। অভিজিত্ হত্যা রহস্য উন্মোচন না হতেই ৩০ মার্চ সকালে রাজধানীর তেজগাঁও থানাধীন বেগুনবাড়ী এলাকায় খুন করা হয় আরেক ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে। অভিজিতের মতো তাকেও চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

মামলার তদন্ত নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে অভিজিতের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক অধ্যাপক অজয় রায় বলেন, প্রায় এক বছর চলে গেল। হত্যাকাণ্ডে জড়িত কেউ গ্রেফতার হয়নি। পুলিশ আর কত সান্ত্বনা দেবে আমাদের! তবে আমার জানা মতে, প্রকৃতপক্ষে মামলার কোনো অগ্রগতিই নেই। দেখা যাক কী হয়!

শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতির প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন নৃশংসভাবে খুন হন গত বছর ৩১ অক্টোবর। প্রায় একই সময়ে মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের প্রকাশক ও ব্লগার আহমেদ রশিদ টুটুল, তার বন্ধু রণদীপন বসু, তারেক রহিমকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে দুর্বৃত্তরা। নিহত দীপনের বাবা ঢাবির সাবেক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, দেশে আইনের শাসনের প্রয়োজনেই দীপন হত্যার বিচার হওয়া উচিত। তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গেও অনেক দিন ধরে তার কোনো যোগাযোগ হচ্ছে না বলে জানান তিনি। অভিজিত্ ও দীপন হত্যা মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার রাজীব আল মাসুদ জানান, দুটি মামলায়ই তদন্তের ক্ষেত্রে প্রথম থেকে যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছিল ঠিক একইভাবে এখনো গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। হত্যা রহস্য উন্মোচনের ব্যাপারে আমরা শতভাগ আশাবাদী। গত ৫ অক্টোবর রাজধানীর বাড্ডায় খুন হন আধ্যাত্মিক নেতা প্রকৌশলী খিজির খান। খিজির হত্যাকাণ্ডে তরিকুল ইসলাম মিঠু এবং গোলাম মোস্তফা রাসেল জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। মিঠু দুই বছর আগে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে রাজধানীর গোপীবাগে কথিত পীর লুত্ফর রহমানসহ ছয়জনকে গলা কেটে হত্যায়ও অংশ নিয়েছিলেন বলে আদালতে স্বীকার করেছেন। দুটি চাঞ্চল্যকর হত্যার বিষয়ে সবকিছুই উদ্ঘাটন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে সূত্র জানায়, চার্জশিট কবে দেওয়া হবে এ ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ছয় খুনের তদন্তভার বর্তমানে ডিবির চার নম্বর টিম থেকে দুই নম্বর টিমে স্থানান্তর করা হয়েছে। কিছু দিন আগে মামলার তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন পরিদর্শক আবুয়াল খায়ের মাতুব্বর। তিনি বর্তমানে বদলি হয়ে বিশেষ শাখায় কর্মরত। গত বছরের ৩ অক্টোবর রংপুরে জাপানি নাগরিক হোসি কোনিও হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ছয়জন গ্রেফতার হলেও মাসুদ রানা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এর আগে ২৮ সেপ্টেম্বর ইতালির নাগরিক তাভেলা সিজার খুন হন। ওই হত্যাকাণ্ডের অংশ নেওয়া শুটার রুবেলসহ চারজনকে গ্রেফতারের কথা জানিয়েছে পুলিশ। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খুব শিগগিরই মামলার চার্জশিট দেওয়া হবে। কোনিও হত্যার বিষয়ে পুলিশের রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি হুমায়ুন কবির বলেন, তদন্তে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। সম্প্রতি মাসুদ রানা নামের জেএমবির এক সদস্যকে গ্রেফতার করার পর সে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। মাসুদ রানা নিজেই হোসি কোনিওকে গুলি করেছে। আদালতে দেওয়া মাসুদ রানার স্বীকারোক্তির পক্ষে সব ধরনের আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। ব্লগার নীলাদ্রি নিলয় হত্যা মামলায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে মন্তব্যদাতা মুফতি আবদুল গাফফারসহ মোট সাতজনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। ওই ঘটনায় গ্রেফতারকৃত বাকিরা হলো— সাদ আল নাহীন, মাসুম রানা, কাওসার হোসেন খান, কামাল হোসেন সরদার, তারিকুল ইসলাম তারেক ও মোর্তজা ফয়সাল সাব্বির। নিলয় হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক মাহবুবুর রহমান বলেন, আমরা সাতজনকে গ্রেফতার করেছি। তাদের অনেককেই রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আমাদের কাছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে। আরও কয়েকজন সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করার চেষ্টা চলছে। অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, দুই বছরের বেশি সময় পর ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যা মামলায় রায় হলো সম্প্রতি। বাকি হত্যা মামলাগুলোরও দ্রুত বিচারের দাবি তুলছেন তারা। তাদের দাবি, এরই মধ্যে অনেক ব্লগারকে জীবন বাঁচাতে দেশ ছাড়তে হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের শিকার বাকি চার ব্লগারের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি না হলে ঝুঁকি  আরও বাড়বে বলে শঙ্কা তাদের। ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্লগার রাজীবকে হত্যা করা হয়। গত বছর খুন হয়েছেন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান বাবু, সিলেটে মুক্তমনা ব্লগের আরেক ব্লগার, লেখক ও ব্যাংক কর্মকর্তা অনন্ত বিজয় দাস, ঢাকায় ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় (নিলয় নীল)। তবে রাজীব হত্যা মামলাটি ছাড়া অন্য ব্লগার হত্যাকাণ্ডগুলোর বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। কেবল ওয়াশিকুরের মামলায় পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। প্রায় সবকটি ব্লগার হত্যা মামলা ‘সন্দেহ আর তদন্তে’র মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে।

সর্বশেষ খবর