শিরোনাম
শুক্রবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

বেসরকারি হাসপাতাল মানেই ব্যবসা

মাহমুদ আজহার

বেসরকারি হাসপাতাল মানেই ব্যবসা

সম্প্রতি রাজধানীর গ্রিন রোডে একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আবদুর রব মোল্লা নামে ৬৪ বছর বয়সী এক রোগী। তিনি বাতজ্বরে ভুগছিলেন। স্বজনদের অভিযোগ, হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিত্সক ও নার্স একটি ইনজেকশন পুশ করেন। এর পরপরই ওই রোগীর মৃত্যু হয়। রোগীকে ভুল চিকিৎসা দিয়ে ‘হত্যা’ করা হয়েছে বলেও অভিযোগ স্বজনদের। মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলা স্বাস্ব্য কমপ্লেক্সে গতকাল বুধবার সুমিত্রা পাল নামের এক প্রসূতির মৃত্যুর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় পুলিশ একজনকে গ্রেফতারও করেছে। একই রকম ঘটনা ঘটেছে লক্ষ্মীপুরে। রামগঞ্জের একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যুর পর ভাঙচুর করেছেন স্থানীয়রা। সারা দেশের চালচিত্র প্রায় এক। বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় প্রতিনিয়ত ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। অভিযুক্ত হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। বরং ব্যাঙের ছাতার মতো প্রতিনিয়ত গজিয়ে উঠছে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা নেই। দেখারও কেউ নেই। অসহায় রোগীরা। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) প্রকাশিত হেলথ বুলেটিনের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশে বৈধ নিবন্ধিত দুই হাজার ৯৮৩টি হাসপাতাল-ক্লিনিক ও পাঁচ হাজার ২২০টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এর বাইরে ঢাকাসহ সারা দেশে হাজার হাজার হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার খুলে করা হচ্ছে ‘অবৈধ’ বাণিজ্য। এতে সাধারণ মানুষ শিকার হচ্ছে চরম হয়রানির। ভুক্তভোগীরা বলছেন, বেসরকারি হাসপাতাল মানেই ব্যবসা। মানহীন হাসপাতালগুলোতে নেই চিকিৎসাসেবা। যন্ত্রপাতিও নেই। দক্ষ চিকিত্সক ও নার্স নেই। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হাসপাতাল-ক্লিনিক পরিচালনার জন্য ১৯৮২ সালের ‘দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেশনস)’ অধ্যাদেশ অনুযায়ী শুধু মেডিসিন, সার্জারি ও গাইনি—এ তিন রোগের চিকিৎসা দেওয়ার বিধান রয়েছে। ওই অধ্যাদেশ অনুযায়ী, বেসরকারি হাসপাতালগুলো হূদরোগ, কিডনি, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার ইত্যাদির বিশেষায়িত চিকিৎসার চিকিৎসা দিতে পারবে না। একইভাবে আইসিইউ, এনআইসিইউ, পিআইসিইউ, সিসিইউ, ডায়ালসিস, মাদকাসক্তি ও মানসিক রোগ এবং ডেন্টাল রোগের চিকিৎসাও দেওয়া যাবে না। কিন্তু বছরের পর বছর সারা দেশে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রতিষ্ঠিত হাসপাতাল-ক্লিনিকে বিশেষায়িত রোগের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। রাজধানীর পাঁচ তারকা হাসপাতালের পাশাপাশি যত্রতত্র গড়ে ওঠা হাজার হাজার হাসপাতালে এ চিকিৎসা চলছে। এর ফলে প্রতিনিয়ত পাওয়া যাচ্ছে রোগীর মৃত্যুর খবর। ঘটছে ভাঙচুরের ঘটনা। জানা যায়, প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে একজন রোগীকে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার দীর্ঘ তালিকা তুলে দেওয়া হয়।  টাকাও গুনতে হয় অনেক, যা হতদরিদ্র রোগীদের জোগাড় করা দুষ্কর হয়ে পড়ে। মানহীন যন্ত্রপাতি, পর্যাপ্ত আইসিইউর ব্যবস্থা না থাকা, বিকল যন্ত্রপাতিতে নানা ভোগান্তিতেও পড়তে হয় রোগীদের। চিকিৎসা-সংশ্লিষ্টরা জানান, বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক পরিচালনার জন্য প্রথমত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে। প্রয়োজন দক্ষ চিকিত্সকের। যন্ত্রপাতিও থাকতে হবে পর্যাপ্ত ও মানসম্মত। হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। থাকতে হবে টেকনিশিয়ান, নার্সসহ পর্যাপ্ত চিকিৎসা-সামগ্রী। ক্লিনিক বা হাসপাতালের এক্স-রে মেশিনের প্রটেকশনও জরুরি। যত্রতত্র সিরিঞ্জ ফেলানো যাবে না। এতে হেপাটাইটিস বি-সহ নানা জীবাণু ছড়িয়ে যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সারা দেশে প্রতিনিয়ত অবৈধভাবে গড়ে উঠছে মানহীন ক্লিনিক-হাসপাতাল। এগুলো যথাযথভাবে মনিটর করা হচ্ছে না। ফলে নানা ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। মাঝেমধ্যে অভিযানও চলে। কিন্তু এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকে না। ফলে প্রতিনিয়ত ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে হাসপাতাল। এতে চিকিৎসাসেবার মান নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক।’ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতালের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যবসা। উপযুক্ত চিকিত্সক, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবক-সেবিকা (নার্স), আয়া, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা-সরঞ্জাম নেই অধিকাংশেরই। ভুয়া চিকিত্সক, আনাড়ি টেকনিশিয়ান ও অদক্ষ লোকবল দিয়েই চলছে চিকিৎসাসেবা। যদিও হাসপাতালের সামনে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের নামের তালিকা-সংবলিত বিশাল সাইনবোর্ড সাঁটানো থাকে। বেসরকারি হাসপাতালের মালিকরা তাদের নিকটবর্তী এলাকার স্বাস্থ্য উপকেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, জেলার সদর হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকদের নামের তালিকা দিয়ে সাইনবোর্ড তৈরি করে নিজস্ব হাসপাতালের সামনে ঝুলিয়ে রাখেন। এ নিয়ে নানা অভিযোগ থাকলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না। সূত্রগুলো জানায়, অবৈধভাবে বেসরকারি হাসপাতালগুলো গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে প্রভাবশালীদের কালো হাত। তাদের ছত্রচ্ছায়ায় অবৈধ হাসপাতাল গড়ে তুলছে একশ্রেণির মুনাফাখোর। এ অবস্থায় বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক পরিচালনার ক্ষেত্রে নতুন আইন করার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সরকার। এরই মধ্যে আইনের খসড়াও প্রস্তুত করা হয়েছে। পাঁচ তারকা হাসপাতালগুলো বছরের পর বছর রোগীদের কাছ থেকে নানাভাবে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। সুষ্ঠু তদারকির অভাবে সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও মন্ত্রণালয়ের একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা অনেক ক্ষেত্রে হাসপাতাল বা ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিচ্ছেন। ভুয়া চিকিত্সকসহ অদক্ষ লোকবল দিয়ে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা চলছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. এ কে এম মোস্তফা হোসেন বলেন, ‘মুদিদোকানের মতো যত্রতত্র গড়ে উঠছে বেসরকারি ক্লিনিক আর হাসপাতাল। বেশির ভাগ হাসপাতালেই নেই দক্ষ চিকিত্সক, নার্স, যন্ত্রপাতি, টেকনিশিয়ান আর প্রয়োজনীয় সামগ্রী। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরকে এ বিষয়ে কঠোর পর্যবেক্ষণ করতে হবে। নইলে প্রতিনিয়ত ভুল চিকিৎসায় মানুষের মৃত্যুর মিছিল বাড়তেই থাকবে।

সর্বশেষ খবর