শুক্রবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা
বিশেষজ্ঞ মত

সেবা এখন পণ্য বঞ্চিত রোগী

রফিকুল ইসলাম রনি

সেবা এখন পণ্য বঞ্চিত রোগী

চিকিৎসাসেবাকে পণ্য হিসেবে গ্রহণ করায় মানুষ সঠিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে মনে করছেন দেশের স্বনামধন্য চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মানব সেবার মহান ব্রত চিকিৎসাসেবাকে আজ পণ্য হিসেবে নেওয়া হচ্ছে। সেবার  চেয়ে ব্যবসাকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, যে কারণে মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ ছাড়াও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার নামে অযাচিতভাবে রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়, যা অনেকাংশেই প্রয়োজন হয় না। মেডিকেল বোর্ড থেকে নিয়মিত তদারকি না করার কারণেও দিনের পর দিন বেসরকারি হাসপাতালগুলো চিকিৎসার নামে মানুষের গলা কাটার সুযোগ পাচ্ছে। এ ছাড়া যারা রোগীদের জিম্মি করে টাকা আদায় করছে তাদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল, দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ, চিকিৎসক ও হাসপাতাল মালিকদের আরও মানবিক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট চিকিৎসক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শিক্ষা এবং চিকিৎসা যদি পণ্য হয়ে যায়, তার গুণগত মান থাকে না। ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে কেউ লাভবান হয়, কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাম্যতা, বাস্তবিক অবস্থা ও মানবিকতা থাকে না। মানুষের সঠিক সেবা নিশ্চিত করতে আমাদের দেশের ডাক্তারদের যেমন মানবিক হওয়া উচিত। তেমনি হাসপাতাল ও ক্লিনিক মালিকদের আরও বেশি মানবিক হওয়া উচিত। তা না হলে দেশের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শহিদুল্লাহ সিকদার বলেন, বেসরকারি হাসপাতালে অযাচিতভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়, যা অনেকাংশেই প্রয়োজন পড়ে না। এসব করা হয় শুধু টাকা উপার্জনের জন্য। চিকিৎসা আজ অনেকেই পণ্য হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এই প্রবণতা শুধু ডাক্তারদের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়, অন্য পেশার অর্থবিত্তের মালিকদেরও এদিকে ঝুঁকতে দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে আমাদের দেশের মানুষ অর্থ দিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন। তারা মনে করেন, শুধু টাকা দিলেই সেবা মেলে, আসলে এ ধারণা সঠিক নয়। কারণ কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করেও সঠিক বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পাওয়া যায় না। দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে এখনো ভালো ও উন্নত মানের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। এখনো গরিব ও সাধারণ মানুষের কাছে উত্তম চিকিৎসা কেন্দ্র সরকারি হাসপাতাল। স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, আমাদের মেডিকেল বোর্ড আছে, সেই মেডিকেল বোর্ডের গাইড লাইন অনুযায়ী কাজ করা উচিত। মেডিকেল বোর্ডের একটি টিম প্রতিনিয়ত হাসপাতালগুলোতে পরিদর্শন করা দরকার। এ ছাড়া একটি হটলাইন খোলা দরকার। সেখানে যে কেউ অভিযোগ করলেই সেখানে তদন্ত করা উচিত। হাসপাতাল এমন একটি জায়গা যেখানে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়। নিয়মিত মনিটরিং করা হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও বুঝত তারা একটি মনিটরিংয়ের মধ্যে আছে, তাহলে তারাও ভয়ে ভয়ে থাকবে। চিকিৎসা সেবার নামে যা খুশি তা করা যাবে না। আমরা দেখি হাসপাতালে বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালানো হয়। এতে র‌্যাব ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা যান। কিন্তু তাদের সঙ্গে যদি কোনো ডাক্তার যান, তাহলে তাদের অনুসন্ধানটা আরও বেশি শক্তিশালী হয়। সেই কাজটি করা হচ্ছে না। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, হাসপাতালগুলোতে ভুল চিকিৎসায় কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নেওয়ার চেয়ে ভয়াবহ ঘটনা হচ্ছে সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে নেওয়া। এর চেয়ে বড় ক্রাইম আর কিছুই হতে পারে না। ভুল চিকিৎসা বা রোগীকে জিম্মি করে টাকা আদায় করার ব্যাপারে আমরা কোনো ডাক্তারকে শাস্তি দেইনি, শাস্তি দিলে সারা দেশে হরতাল হয়, রোগীদের সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই জায়গাগুলো থেকে বেরিয়ে আসার অন্যতম কাজ হচ্ছে, সরকারকে কঠোর থেকে আরও কঠোরতর হওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, আইন থাকলেও সঠিক প্রয়োগ না থাকায় নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের দেশে আইন করতে হবে সর্বকালের সর্বসময়ের জন্য সর্বদলীয়ভাবে যেটা বাস্তবায়ন করা যায়। সেটা একেবারেই নেই। যে দল যখন ক্ষমতায় আসবে, তারা যেভাবে খুশি সেভাবে চালাবে, সেটা হবে না।  বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রাকিবুল ইসলাম লিটু বলেন, সেবা দেওয়ার নামে যেসব বেসরকারি হাসপাতাল রোগীদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করছে তাদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা উচিত। যেসব ডাক্তার রোগীদের হয়রানি করেন তাদেরও রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা উচিত। তাদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার নৈতিক অধিকার নেই। অনেক বেসরকারি হাসপাতাল রেজিস্ট্রেশন দেওয়ার সময় বলেন, ১০ ভাগ ছিট ফ্রি রাখবেন। কিন্তু পরে তারা কেউ ফ্রি রাখেন না। ফ্রি রাখলে অনেক গরিব মানুষ সেবা নিতে পারত। অনেক সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগী আটকিয়ে টাকা আদায় করা শোভনীয় নয়। প্রয়োজনে তাদের সময় দেওয়া যেতে পারে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর