রবিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা
শফিক রেহমান

ভালোবাসা বিষয়ক মন্ত্রণালয় চাই

শফিউল আলম দোলন

ভালোবাসা বিষয়ক মন্ত্রণালয় চাই

দেশে ‘ভালোবাসা ও সহিষ্ণুতা’ বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠনের দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্ট লেখক ও বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবসের প্রবর্তক শফিক রেহমান। তিনি বলেন, সম্প্রতি সংযুক্ত আরব-আমিরাতে ‘সুখ’ বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করে মন্ত্রীও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সরকারের প্রতি ‘ভালোবাসা’ মন্ত্রণালয় গঠনের অনুরোধ জানিয়ে বিশিষ্ট এই লেখক বলেন, রাজনৈতিক, সামাজিক, মানবাধিকারসহ সর্বক্ষেত্রেই বাংলাদেশের মানুষ এখন এক অসহায় অবস্থার মধ্যে আছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের অনেক নেতা-কর্মী ফেরারি জীবনযাপন করছেন। স্ত্রী-সন্তানসহ ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে দূরে অবস্থান করছেন অনেকে। কিন্তু আমরা এটা চাই না। আমরা চাই দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থাকবে। এ জন্য সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে মায়া-মমতার সৃষ্টি করতে হবে। আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে গতকাল সন্ধ্যায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাত্কারে তিনি এই অভিমত ব্যক্ত করেন। শফিক রেহমান বলেন, ভালোবাসা নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে নেতৃত্ব দিতে পারে। কারণ, ভালোবাসার অনেক উজ্জ্বল উদাহরণ রয়েছে এ দেশে। তিনি বলেন, বগুড়াতে যে বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনী আছে উপমহাদেশে তেমন কোনো কাহিনী নেই। তাজমহলকে অনেকে ভালোবাসার প্রতীক বলেন। কিন্তু সম্রাট শাহজাহানের একাধিক প্রেম ছিল। নবম সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মমতাজ মারা গিয়েছিলেন। সমাধিটা কার প্রতি কার ভালোবাসার নিদর্শন আমি কিন্তু আজ পর্যন্তও পরিষ্কার নই। তিনি বলেন, এটা তো সম্রাটের ইগোও হতে পারে যে, আমি একটা বিশালতম জিনিস বানালাম। কিন্তু যদি এই উপমহাদেশে নিখাঁদ ভালোবাসার গল্প থাকে, আমি বলব সেটি বেহুলা-লখিন্দরের গল্প। তাছাড়া বেহুলা-লখিন্দরের সমাপ্তি মিলনাত্মক। ভালোবাসায় এর চেয়ে উজ্জ্বল নিদর্শন আর কী হতে পারে? এটাকে যদি আমরা সেল করতে পারতাম, তাহলে সারা বিশ্ব থেকেই লোক আসত এটা দেখতে।

‘লাল গোলাপ’ খ্যাত চিরতরুণ সাংবাদিক শফিক রেহমান নব্বই দশকের বহুল আলোচিত সাপ্তাহিক যায়যায়দিনের মাধ্যমেই প্রতি বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবসের সূচনা করেন। এ সময় নিজের উদ্যোগে ভালোবাসার উপহার সামগ্রীরও প্রবর্তন করেন তিনি। পরে ২০০৬ সালে যায়যায়দিন দৈনিক হিসেবে প্রকাশিত হলে এর তেজগাঁও কার্যালয়ের সামনের সড়কটি ‘লাভ লেন’ হিসেবে ঘোষণা করেন তিনি। সিটি করপোরেশন কর্তৃক স্বীকৃত সড়কের নাম এটি।

ভালোবাসায় বিশ্ব নেতৃত্বে যেতে সরকার কী করতে পারে জানতে চাইলে শফিক রেহমান বলেন, বিএনপি সরকার যদি কখনো ক্ষমতায় আসে তাহলে এটা আমি একদিন করে ছাড়ব। আর যদি এখনই এই আইডিয়াটা আওয়ামী লীগ সরকার হাইজ্যাক করে তাহলে আমি আরও খুশি হব। বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনীর স্থাপনাগুলো কীভাবে উন্নয়ন করা যায় জানতে চাইলে শফিক রেহমান বলেন, এটি একটি ইউনিক প্রেমের গল্প। ইউনিসেফের সাহায্য নিয়ে এটার উন্নয়ন করা যেতে পারে। যেহেতু মূল জায়গাটা এখনো অক্ষত রয়েছে। প্যারিসে গেলে যেমন আইফেল টাওয়ার, আমেরিকা গেলে স্ট্যাচু অব লিবার্টি, ভারতে গেলে তাজমহল কেনে মানুষ। তেমনি লখিন্দরের কোলে মাথা রেখে বেহুলা যে কলার ভেলায় মশারি টানিয়ে ভেসে গিয়েছিল আমরা কিন্তু সেটা বানিয়ে বিক্রি করতে পারি। এটা বিদেশিরা দেখলে আগ্রহী হবে। আর আমার প্ল্যান আছে, একটা ভালোবাসার দিন আমি ওখানে পালন করব। বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবস পালন সম্পর্কে শফিক রেহমান বলেন, ১৯৯৩ সালে আমি যখন সাপ্তাহিক যায়যায়দিন সম্পাদনা করছিলাম তখন ভাবলাম, এবারের বিশেষ সংখ্যাটি ভালোবাসার ওপর করব। তখনো আমাদের মিডিয়ায় ঈদ, পূজা কিংবা বর্ষ শুরু বা বর্ষ শেষ অথবা ২৬ মার্চ, ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৬ ডিসেম্বর বিশেষ সংখ্যা বের হয়। মনে হচ্ছিল একঘেয়েমি হয়ে যাচ্ছে। তাই আমি পাঠককে বলি যে, আপনারাই লিখুন, আপনাদের জীবনের অভিজ্ঞতা। যায়যায়দিন আমার হাতছাড়া হয়ে গেলেও এখনো আমি সেই ধারাবাহিকতা রেখেছি ‘মৌচাকে ঢিল’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করে।

শফিক রেহমান বলেন, ১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম যায়যায়দিনের ভালোবাসা দিবস সংখ্যা প্রকাশিত হয়। আমি ভেবে দেখলাম ১৪ ফেব্রুয়ারি হচ্ছে ২ ফাল্গুন। ১৩ ফেব্রুয়ারি হচ্ছে পয়লা বসন্ত বা স্প্রিং। যার সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক জড়িয়ে আছে। কাকতালীয়ভাবে তাই ভালোবাসা দিবস বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য এবং সময়োপযোগী। পয়লা বসন্তে ছেলেমেয়েরা হলুদ পাঞ্জাবি, শাড়ি পরে বের হয়। বইমেলা চলে। অনেক কিছু চিন্তা করে মনে হলো এটাই তো আসল সময়।

তিনি বলেন, পশ্চিমা দেশগুলোতে ভ্যালেন্টাইন ডে পালিত হয় প্রেমিক-প্রেমিকা এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। আমি চিন্তা করলাম, এটার পরিধি বাড়াতে হবে। নামটা বদলে দিতে হবে। সেটায় যেন বাঙালিত্ব থাকে। আমি যখন কলকাতায় ছিলাম তখন আমাদের আশপাশে অনেকেই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। আমার বাড়িওয়ালাও ছিলেন হিন্দু ব্রাহ্মণ। আমি খুব মুগ্ধ হতাম যখন আমার হাতে তাদের মেয়েরা রাখি পরিয়ে দিত। এই যে ভাই আর বোনের মধ্যে সম্পর্ক এটা একটা আবহমান বাংলার সম্পর্ক। এগুলো চালু হওয়া উচিত। তিনি বলেন, ভালোবাসা তো শুধু প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী নয়, এটা ভাইবোনের মধ্যে হতে পারে, বাবা-মা সন্তানের মধ্যে হতে পারে। সবচেয়ে বেশি ভালোবাসার সম্পর্ক হচ্ছে মা এবং সন্তানের মধ্যে। রাস্তায় বের হলেও লেখা দেখা যায় ‘মায়ের দোয়া’। সে দিক বিবেচনা করে আমি ভালোবাসা সংখ্যা বের করলাম ১৯৯৩ সালে। মাত্র ৩২ পৃষ্ঠার মধ্যে তখন যায়যায়দিন বের করতাম। শফিক রেহমান বলেন, বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবসের প্রচলনের এবার ২৩ বছর চলছে। এই ২৩ বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। অনেকে এই দিনে বিয়ে করে, প্রথম হাত ধরে ভালোবাসার কথা বলে, চুমু খায়, বেড়াতে যায়, ডেট করে। এটা আমার জন্য নিতান্তই আনন্দের বিষয়। ভালোবাসার বাণী বাবা-মা, ভাইবোন, পাড়া-প্রতিবেশী, পুলিশের সঙ্গে জনগণের, বাড়িওয়ালার সঙ্গে ভাড়াটিয়ার হতে পারে। যেখানেই সংঘাত সেখানেই যদি ভালোবাসা থাকে তাহলে দেশটা অনেক শান্তিপূর্ণ অবস্থায় থাকবে।

ভালোবাসা দিবসের প্রবর্তক জানান, দেশে ভালোবাসা দিবসের প্রচলনের পর আমি সমালোচিত হয়েছিলাম। আমার নিকট বন্ধুরাই মনে করেছে, আমি একটা পশ্চিমা জিনিস আমদানি করছি। আমার কথা হলো, আমাদের চীন, জাপান, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো করতে হবে। পশ্চিমা সব ভালো জিনিস এনে আমাদের মতো করে ব্যবহার করতে হবে। আজকে আমরা যে আইপ্যাড ব্যবহার করি এটা কিন্তু আমেরিকার আবিষ্কার। কিন্তু তৈরি হচ্ছে চীনে, জাপানে। পশ্চিমাদের থেকে নেব না বললে কিন্তু ভুল হবে। রবীন্দ্রনাথ তার সময়ে বড় বিপ্লবী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ পৃথিবী ঘুরে ঘুরে ভালো কিছু নিয়ে এসেছিলেন। রবিঠাকুর প্রকৃতই বিপ্লবী এবং সমাজ সংস্কারক ছিলেন। এগুলো মনে করেই আমি করেছি। কিন্তু আমাকে তখন কেউ পাত্তা দেয়নি। উল্টো আমাকে উপহাস করা হলো শফিক রেহমান ‘গদি বালিশ’ বিক্রি করে। কারণ, আমি ভালোবাসার কুশন বের করেছিলাম। ভালোবাসা সংখ্যায় নানারকম ব্যাজ, ব্যাগ, চকোলেট, ফ্রি ব্যাগ দেওয়া ইত্যাদি আমি অনেক কিছু করেছিলাম। যাতে বাংলাদেশে ভালোবাসার বাণী ছড়িয়ে পড়ে। আমি খুশি যে এদেশের সুশীল সমাজের সংকীর্ণতা গোঁড়ামি তরুণ সমাজ উপেক্ষা করে তারা সাদরে এটা গ্রহণ করেছে। এত দ্রুত এটা ছড়াবে তা আমি ভাবিনি।

সর্বশেষ খবর