সোমবার, ২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

অপরাধীরা বেপরোয়া

বেড়েছে খুনখারাবি ডাকাতি অপহরণ - ঠেকানো যাচ্ছে না শিশু হত্যা

মির্জা মেহেদী তমাল

অপরাধীরা বেপরোয়া

কয়েক দিন আগের ঘটনা। রাজধানীর দারুসসালাম এলাকা থেকে নিখোঁজ হন হোটেল ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম জুনায়েদ (৪২)। একদিন পর জুনায়েদের গুলিবিদ্ধ লাশ টোলারবাগ ফুটপাথ থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। এর কয়েক দিন আগে রূপনগর এলাকা থেকে উদ্ধার হয় জাতীয় পার্টি নেতা সৈয়দ মিজানুর রহমান হিমুর লাশ। সন্ত্রাসীরা তাকে কুপিয়ে হত্যার পর লাশ ফেলে যায়। গত শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর ডেমরায় দিনদুপুরে কেয়া জুয়েলার্স নামে একটি সোনার দোকান লুট হয়। দোকান কর্মচারীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ৮০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও পাঁচ লাখ টাকা লুট করে ডাকাত দল। সারুলিয়া মনুমোল্লা শপিং কমপ্লেক্সের দ্বিতীয় তলায় এ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মিরপুরের এফ ব্লক ৯ নম্বর সড়কে বিকাশ এজেন্টের টাকা ছিনতাই হয়। এ সময় এলাকাবাসী প্রতিরোধের চেষ্টা করলে ছিনতাইকারীরা এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে। এ সময় একজন পথচারী আহত হন। খুন, ডাকাতি আর ছিনতাইয়ের এই চিত্র এখন সারা দেশের। প্রতিদিনই রাজধানীসহ সারা দেশে নির্মম খুনের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বাসাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। দিনদুপুরে ছিনতাইকারীরা গুলি করে ছিনিয়ে নিচ্ছে টাকা ও মূল্যবান সামগ্রী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। খুনখারাবি থেকে শুরু করে ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা বেড়ে গেছে। বিশেষ করে শিশু হত্যার ঘটনা কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। প্রায় প্রতিদিনই শিশুর লাশ উদ্ধারের ঘটনা ঘটছে আশঙ্কাজনক হারে। বাংলাদেশে অবস্থান করা অবৈধ বিদেশি নাগরিকরাও নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। পুলিশের টহলও কোনো কাজে আসছে না। এ অবস্থায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি হওয়ায় পুলিশ প্রশাসনও উদ্বিগ্ন। গত তিন মাসে রাজধানীসহ সারা দেশে সহস্রাধিক খুনের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে দুই হাজারেরও বেশি। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার হিসাবে গত দেড় মাসে ৪৫টি শিশু খুনের শিকার হয়। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, অপরাধীদের গ্রেফতার করেও আটকে রাখা যাচ্ছে না। কারাগার থেকে বেরিয়েই তারা খুন, ডাকাতিসহ বড় ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কোনোভাবেই সন্তোষজনক নয়। নিত্য ঘটছে চরম উদ্বেগজনক সব ঘটনা। খুন, গুম, অপহরণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ নানা রকম দুষ্কর্ম ঘটে চলেছে অব্যাহত গতিতে। মানুষ ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপদ নয়। অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কর্মতত্পরতা অপরাধীদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিপরীতে একেবারেই নৈরাশ্যজনক। পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, দেশে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির অন্তত চারটি সুস্পষ্ট কারণ রয়েছে। এগুলো হলো— ক্রাইম ম্যাপিং হট স্পট চিহ্নিত না করা, খুনি বা অপরাধীকে ভয় দেখানোয় ব্যর্থতা, দুর্বল মামলা ও তদন্ত রিপোর্ট এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাব। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক প্রভাবে শাস্তি এড়িয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি। এর ফলে একদিকে যেমন অপরাধীদের গায়ে হাত দেওয়া যাচ্ছে না, অন্যদিকে অপরাধী গ্রেফতার হলেও তাকে আটকে রাখা যাচ্ছে না। পুলিশের সাবেক আইজি এম শাহজাহান বলেন, নৃশংস হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য অপরাধ কমাতে হলে প্রথমে চিহ্নিত কারণগুলো নিরসন করতে হবে। তা না হলে সমাজে অপরাধের মাত্রা কমবে না। অপরাধের ঘটনা যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে মূল অপরাধীকে চিহ্নিত করে তাকে আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করা গেলে বিভিন্ন অপরাধ, বিশেষ করে নৃশংস হত্যাকাণ্ডসহ সামাজিক অপরাধগুলো কমে আসবে— এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। অবশ্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে জবাবদিহিতাও প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মানুষ ক্রমেই সম্পদের জন্য নৃশংস হয়ে উঠছে। সমাজের একশ্রেণির মানুষের কাছে অনেক বেশি অর্থ এসে পড়েছে, আরেক শ্রেণির মানুষের কাছে কোনো অর্থই নেই। ফলে স্বল্প সময়ে ধনী হওয়ার জন্য তারা এখন নৃশংস অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এ জন্য শিশুদের হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করছে না। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাঁদাবাজি নিয়ে বেশি ব্যস্ত। এক্ষেত্রে অন্যের নিরাপত্তায় তাদের তত্পর দেখা যাচ্ছে না। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. মোহিত কামাল বলেন, অপরাধীদের বিচার হয় না বলেই সমাজে নিষ্ঠুরতা দিন দিন বেড়ে চলছে। ‘ফ্রাসটেশন রিলিজ এগ্রেশন’ এই থিওরির মতো করে বলতে হয় হতাশা দূর করতে মানুষ নৃশংসতায় জড়াচ্ছেন। কিছু ক্ষেত্রে ত্রুটিপূর্ণ আচরণের ব্যক্তিরাও বর্বর হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। শিশুরা তাদের মা-বাবাকে নিষ্ঠুর আচরণ করতে দেখেও সহিংস আচরণ শিখছে। সম্প্রতি মাদকের ভয়াবহ ব্যবহারের ফলে মানুষ নির্দয় আচরণ বেশি করছে। এই মাদক মস্তিষ্কে ঢুকে মানুষের মূল্যবোধ নষ্ট করে দিচ্ছে। মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক মেহতাব খানম বলেন, তরুণ প্রজন্ম বর্তমানে একটি অস্থির সমাজ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সময় পার করছে। ফলে সহজেই যুবকরা সহিংসতামূলক আচরণে প্রলুব্ধ হচ্ছে। মোবাইল-ইন্টারনেট প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে যুবকরা নেতিবাচক আচরণে প্রলুব্ধ হচ্ছে।

ডাকাতি : রাজধানীসহ সারা দেশে হঠাত্ ডাকাতি বেড়েছে। দেশের কোথাও না কোথাও প্রায় প্রতিদিনই এমন ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। বাসাবাড়িতে ডাকাতি হচ্ছে, লুট হচ্ছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। মহাসড়কে যানবাহন থামিয়ে লুটপাট করছে দুর্বৃত্তরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল কোনো কাজে আসছে না। ডাকাতরাও ধরা পড়ছে না। যে কারণে কোথাও কোথাও জনতা নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে বিভিন্ন স্থানে। আবার কোনো কোনো এলাকায় পুলিশের ভরসায় না থেকে নিজেরাই পাহারার ব্যবস্থা করছেন। এ অবস্থায় ডাকাত আতঙ্ক নিয়ে রাত পার করছে বিভিন্ন জেলার মানুষ। গত দেড় মাসে পুলিশের হিসাবেই ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে প্রায় দু’শ। তবে প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে পাঁচগুণ বেশি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ভুক্তভোগীরা বলছেন, ডাকাতির ঘটনায় মামলা করতে গেলেও পুলিশ তা গ্রহণ করেনি। শেষমেশ তারা চুরির মামলা হিসেবে লিপিবদ্ধ করে। মহাসড়কগুলোতেও ডাকাতির ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে আশঙ্কাজনক হারে। ডাকাত আতঙ্কের কারণে মালবাহী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানসহ অন্যান্য যানবাহন নিরাপদে পৌঁছতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয়ে থাকতে হয় ব্যবসায়ীদের। বিশেষ করে গার্মেন্ট মালামাল, চালভর্তি ট্রাক দুর্বৃত্তের কবলে পড়ছে। গত এক বছরে শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে প্রায় দেড়শ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানভর্তি মালামাল ডাকাতি হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও ঢাকা-আরিচা মহাসড়কেও ডাকাতির ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও পুলিশ সহজে ডাকাতি মামলা লিপিবদ্ধ করতে চায় না। ফলে ডাকাতির প্রকৃত চিত্র পুলিশের পরিসংখ্যানের চেয়েও অনেক বেশি। ডাকাতদের কবলে পড়ে মালামাল খুইয়ে অনেক পরিবহন ব্যবসায়ী নিঃস্ব হয়েছেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-আরিচা মহাসড়কেই ডাকাতদের দৌরাত্ম্য সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ডাকাত চক্রের সদস্যরা সাধারণত নির্দিষ্ট কিছু এলাকা থেকে ট্রাক বা কাভার্ড ভ্যানকে টার্গেট করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জায়গা হচ্ছে চট্টগ্রামের কদমতলী ট্রাকস্ট্যান্ড, নিমতলী, অলংকার, মনসুরাবাদ, সীতাকুণ্ড, বড়দারোগার হাট, মিরসরাই, বড়তাকিয়া, হাজিপুর, কাপ্তানবাজার, গৌরীপুর, গজারিয়া, কাঁচপুর, চিটাগাং রোড, সানারপাড়, তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড ও আশুলিয়া। এ ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গীবাজারসহ গার্মেন্ট অধ্যুষিত এলাকাগুলোতেও এ চক্রের সদস্যরা সক্রিয় রয়েছে। বিভিন্ন কৌশলে তারা টার্গেটকৃত কাভার্ড ভ্যান ও ট্রাকচালককে হাত করে নেয়। তা সম্ভব না হলে নেশাজাতীয় কিছু খাইয়ে অজ্ঞান করে কিংবা চালক বা হেলপারকে খুন করেও তারা মালামালসহ গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে।

ছিনতাই : রাজধানীতে ছিনতাইকারীরাও বেপরোয়া। সাতটি বিশেষ কায়দায় ছিনতাই হচ্ছে রাজধানীসহ সারা দেশে। পেশাদার ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে সর্বস্ব খুইয়েছেন অনেকেই। প্রতিকার চেয়ে আইনের আশ্রয় নিলেও পর্যাপ্ত সুরক্ষা পাচ্ছেন না তারা। উল্টো পুলিশি হয়রানির শিকার হতে হয় তাদের। তবে পুলিশের দাবি, আগের চেয়ে অপরাধ কমেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাস্তা, মার্কেট ও ব্যাংকের সামনে ওত পেতে থাকা এবং সুবিধামতো পেছন থেকে গুলি বা ছুরিকাঘাত করে ছিনতাই করে টাকার ব্যাগ। কখনো কখনো পিস্তলের বাঁট দিয়ে মাথায় আঘাত করে ও ককটেল ফাটিয়ে ছিনতাই করে। আবার কখনো রিকশাযোগে যাওয়া যাত্রীদের পাশ দিয়ে মোটরসাইকেলযোগে ছিনিয়ে নেয় ব্যাগ। যানজটে আটকেপড়া মানুষ রিকশায় থাকা অবস্থায় সামনে ও দুই পাশে তিনটি মোটরসাইকেল ঠেকিয়ে ছিনতাই করা হয়। বাসের জানালার পাশে বসে ফোনে কথা বলার সময় ছোবল মেরে মোবাইল ফোন বা অলঙ্কার ছিনতাই করা হয়। আবার কখনো কখনো যাত্রীভর্তি গাড়িতে পকেট মারে এসব সংঘবদ্ধ অপরাধী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর