বৃহস্পতিবার, ৩ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

লোভে ধ্বংস হচ্ছে সামাজিক মূল্যবোধ

আলী রিয়াজ

লোভে ধ্বংস হচ্ছে সামাজিক মূল্যবোধ

খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান বলেছেন, সার্বিকভাবে আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে। লোভ, লুটপাট, ভোগবাদী উন্মাদনা, আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতায় সামাজিক বন্ধন দিন দিন ক্ষয়িষ্ণু হওয়ার পর এখন ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের অরাজক পরিস্থিতির ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে। যার ফলাফল পিতা-মাতাও তার সন্তানকে হত্যা করছে। নিছক মাতলামি করে মানুষকে গুলি করে হত্যা করছে। মূল্যবোধের এ চরম অবক্ষয় থেকে মুক্তি পেতে হলে রাষ্ট্রকেই উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের সবাইকে সজাগ হতে হবে এমনটি বন্ধ করতে। সাম্প্রতিক সময় শিশু হত্যা, ধর্ষণসহ সামাজিক অপরাধ পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে এসব কথা বলেন তিনি। খালেকুজ্জামান বলেন, সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার জন্য মানুষের শুধু একটি চিন্তা— কীভাবে আরও বেশি সম্পদ বানানো যায়। কোনো দিকে তাকানোর সুযোগ নেই। নীতি-আদর্শ, মূল্যবোধ বাদ দিয়ে রাষ্ট্রও চলছে অর্থ বাড়াও। চারদিকে চকচকে উন্নয়ন। অবকাঠামো, ইট-পাথরের সুউচ্চ ভবন বাড়ছে। তেমনি মূল্যবোধ নিচের দিকে, পতন হচ্ছে। আদর্শবিহীন রাজনীতি মানুষকে সহিংস করে তুলছে। যার প্রভাবে আমরা দেখছি সাম্প্রদায়িকতা, আঞ্চলিকতা। কোনো কারণ ছাড়াই একজন আরেকজনকে খুন করছে। সামান্য স্বার্থের জন্য নিজের সন্তান, ভাই, বোন একে অন্যকে হত্যা করছে।

খালেকুজ্জামান বলেন, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি ও তাদের দোসররা ছাড়া সাড়ে সাত কোটি মানুষ কোনো অপরাধ করেনি। কেউ কাউকে হত্যা করেনি। অচেনা, অজানা মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তার জন্য জীবন দিয়েছে। অস্ত্রহাতে মুক্তিযোদ্ধাকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে। পাকিস্তানি ও রাজাকারদের হাত থেকে বাঁচাতে নিজের জীবন বাজি রেখে পাশে দাঁড়িয়েছে। এ ঐক্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্ভব করেছিল। যে পুলিশবাহিনীর বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, ১৯৭১ সালে তারা জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। তাদের সেদিন কোনো লোভ ছিল না। তারাই আজ মানুষকে আটক করে টাকা আদায় করে। কারোই সেদিন সম্পদের প্রতি লোভ ছিল না। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি তাহলে কেন এত হিংসাত্মক হলো? মানুষ অন্যের পাশে দাঁড়ানো দূরে থাক নিজের সন্তানকেই হত্যা করছে সামান্য সম্পদের লোভে, নিজের ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থের কারণে। যে মূল্যবোধ ’৭১ সালে সৃষ্টি হয়েছিল গত ৪৫ বছরে তা ধ্বংস করা হয়েছে। সামাজিক মূল্যবোধবিধ্বংসী রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছে। যে পদ্ধতিতে আমাদের রাষ্ট্র পরিচালিত হওয়ার কথা ছিল তার বিপরীতে নীতি-আদর্শবিহীন লুটপাট, বিচারহীনতার রাজনীতি সংস্কৃতি চালু হয়েছে। হয়রানি করা হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। একটি গণতান্ত্রিক আইনের শাসনের দেশ হওয়ার কথা ছিল তাকে ধ্বংস করে ভোগবাদী সমাজ তৈরি করা হয়েছে। এ ভোগবাদী মানসিকতা আমাদের সামাজিক বন্ধন ছিন্ন করেছে। একটি একটি করে মূল্যবোধের সব স্তম্ভ ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।

বিশিষ্ট এই বাম রাজনীতিক বলেন, রাজনীতিতে নীতি-আদর্শ না থাকলে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে যায়। মানুষের সহিংস মনোভাব নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আদর্শবাদী সংস্কৃতি থাকতে হবে। কিন্তু গত ৪৫ বছরে আমরা কী দেখেছি? নীতি-আদর্শের সব স্তম্ভ ভেঙে দিয়ে আর্থিক উন্নয়নের চাকচিক্য দেখানো হচ্ছে। বড় বড় অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে, শহরে আকাশচুম্বী ভবন উঠছে। কিন্তু ইট-পাথরের নিচে মূল্যবোধ, নীতি-আদর্শ চাপা পড়ে যাচ্ছে। সামাজিক বন্ধন ছিন্ন হয়ে পারিবারিক বন্ধনও ভেঙে পড়ছে। সামাজিক অস্থিরতা, বিচারহীনতার মাধ্যমে রাষ্ট্র শোষণ করছে। অনিবার্য প্রভাবে সাম্প্রদায়িকতা, আঞ্চলিকতা, ধর্মীয় বিভাজন, লুটপাটের মাধ্যমে উচ্চ শ্রেণির শোষণ মানুষকে সহিংস করে তুলেছে। নৈতিকতাবোধ না থাকলে অঢেল সম্পদের মধ্যেও মানুষ সুখী হতে পারবে না।

যেখানে সব মানুষ একটি পরিবারের মতো বেড়ে ওঠার কথা সেখানে নিজের পরিবারের সদস্যই নিজের নিকটাত্মীয়কে হত্যা করছে। মদ খেয়ে রাস্তায় নেমে সাধারণ মানুষের ওপর গুলি করছে। এমন সমাজ এমনি এমনি তৈরি হয়নি। রাষ্ট্রই এ জটিলতা, সংকট তৈরির পেছনে দায়ী। তিনি বলেন, এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে হলে যে শিক্ষা, সংস্কৃতি প্রয়োজন তেমনিভাবে মানুষকে গড়ে তুলতে হবে। একটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে রাষ্ট্রে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে মারাত্মক ত্রুটি। যে ত্রুটির কারণে কোনো মানুষের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টি হয়নি। এ শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। লুটপাটের অর্থনীতি ও ভোগবাদী মানসিকতা পরিবর্তন করে রাষ্ট্রকে একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমাদের সবাইকে সজাগ হতে হবে। সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টি করে মূল্যবোধসম্পন্ন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা ছাড়া এ অবক্ষয় থেকে কোনো মুক্তি নেই।

সর্বশেষ খবর