রবিবার, ৬ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

এত টিকিট গেল কোথায়

দফায় দফায় সংঘর্ষ ভাঙচুর

জুলকার নাইন

এত টিকিট গেল কোথায়

এশিয়া কাপ ফাইনালের টিকিট প্রত্যাশীদের ওপর গতকাল মিরপুরে লাঠিচার্জ করে পুলিশ —রোহেত রাজীব

ভালোবাসার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ দেখার জন্য ভিআইপিদের চাপে টিকিটের দেখা পান না সাধারণ দর্শক। ব্যাংকের মাধ্যমে সাধারণ দর্শকদের কেনার জন্য মাত্র ১৬ শতাংশ টিকিট থাকে। অর্থাৎ ১০০ টিকিটের ৮৪টিই চলে যায় ভিআইপি নামধারীদের কাছে। এর বড় অংশই সৌজন্য। এভাবেই চলে আসছে ঢাকার স্টেডিয়ামে হওয়া আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলোর টিকিটের ব্যবস্থাপনা। কিন্তু সব ছাপিয়ে গেছে বাংলাদেশ-ভারত এশিয়া কাপের ফাইনাল ম্যাচ। এ ম্যাচের টিকিটের জন্য পড়ে গেছে হাহাকার। কারণ পুরো টিকিটেই ভাগ বসিয়েছে ভিআইপি নামধারী সিন্ডিকেট। সাধারণ দর্শক দূরের কথা, বাংলাদেশ দলের মাশরাফি-মুশফিকরাও পাননি চাহিদামতো টিকিট। গতকাল সকালে নির্ধারিত সময়ের বিক্রির জন্য কোনো টিকিটই ছিল না ইউসিবি ব্যাংকের বুথে। খোদ ইউসিবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘সিন্ডিকেটের কারণে কাঙ্ক্ষিত টিকিট পায়নি ব্যাংক।’ কিন্তু সোনার হরিণ পেতে ব্যাংক-বুথের সামনে জড়ো হওয়া তরুণ দর্শকরা দফায় দফায় পুলিশের সঙ্গে জড়িয়েছেন সংঘর্ষে। সব মিলিয়ে দর্শকের কপালে জুটেছে পুলিশের লাঠির আঘাত আর টিয়ার শেল। বহু ঘটনাপ্রবাহের পর বিকালে কিছু বিক্রি হলেও বেশির ভাগ দর্শকই দেখা পাননি কাঙ্ক্ষিত টিকিটের। আশঙ্কা করা হচ্ছে, আজ ম্যাচের আগে কালোবাজারে উচ্চ মূল্যে বিক্রি হবে এসব টিকিট।

জানা যায়, এশিয়া কাপের ১৩তম আসরের খেলা উপলক্ষে ২২ ফেব্রুয়ারি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) টিকিট বিক্রি শুরু করে। ব্যাংকটির মিরপুর, সোনারগাঁও জনপদ, বিজয়নগর, প্রগতি সরণি, বসুন্ধরা ও নয়াবাজারের মতো ছয়টি শাখায় টিকিট বিক্রির কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে শুধু মিরপুরেই। ফাইনাল ছাড়া বাকি ম্যাচগুলোতে গড়ে মাত্র ১৬ শতাংশ টিকিটই ব্যাংকটি বিক্রি করতে পেরেছে দর্শকদের কাছে। যেমন বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচে শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের মোট প্রায় ২৭ হাজার আসনের মধ্যে ব্যাংকে বিক্রির জন্য বিসিবি থেকে পাঠানো হয়েছে মাত্র ৬ হাজার ৭৫০টি টিকিট। এর মধ্যে ছিল গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডের ৩০টি, ভিআইপি স্ট্যান্ডের ২০০টি, ক্লাব হাউসের ২ হাজার ৮৫২, নর্থ ও সাউথ স্ট্যান্ডের ৩ হাজার ৩৯১ ও ইস্টার্ন গ্যালারির ৩ হাজার ১৭৬টি। বাকি ম্যাচগুলোর চিত্রও ছিল এক। গড়ে ম্যাচগুলোতে ৬ থেকে ৭ হাজারের মধ্যেই টিকিট ব্যাংকে দেওয়া হয়েছে বিক্রির জন্য। তবে এর মধ্যে সবগুলো আবার সাধারণ দর্শকের জন্য যায় না। ব্যাংকের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা ও গুরুত্বপূর্ণ ক্লায়েন্টদের ড্রয়ারেও চলে যায় এর ১০ শতাংশ টিকিট। আর ৭৪ শতাংশ টিকিট গেছে সৌজন্য হিসেবে।

ক্রিকেট সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্বের অন্য কোথাও বাংলাদেশের মতো এত বেশিসংখ্যক টিকিট সৌজন্য হিসেবে যায় না। বিশ্বের অন্যান্য দেশে আইসিসি আয়োজিত টুর্নামেন্টগুলোতে সাধারণত ১০ শতাংশ সৌজন্য টিকিট রাখা হয়। বাকি সবই সাধারণ দর্শকদের জন্য থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে এর ব্যতিক্রম। এখানে দর্শকের চেয়ে অন্যদের কদরই বেশি। যারা স্টেডিয়ামে সরকারি দায়িত্বের অংশ হিসেবে বিদ্যুৎ, পানি ও অন্যান্য সেবা দেন, তারাও সৌজন্য টিকিটের একটি বড় অংশ নিয়ে যান। এর ওপর এবার মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে এসেছে স্পন্সর প্রতিষ্ঠান ‘রিং আইডি’। তারা ম্যাচপ্রতি নিয়ে যায় প্রায় ৫ হাজার টিকিট। আর প্রায় ধরাবাঁধা হিসেবে বিসিবি থেকে প্রতি ম্যাচের ৪-৫ হাজার টিকিট টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে যায় বেসরকারি সংস্থা বেক্সিমকো। এ সংস্থার চাকুরে ও বিসিবির পরিচালক ইসমাইল হায়দার মল্লিক টিকিট-সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিতে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। এর বাইরে এবার ফাইনাল ম্যাচের ‘টিকিট সিন্ডিকেট’ নামের সঙ্গে ক্রীড়াঙ্গনের প্রভাবশালী প্রধানমন্ত্রীর নিকটাত্মীয় এক এমপি ও ব্যবসায়ী সংস্থা একমির নাম ঘুরছে স্টেডিয়ামপাড়ায়। তাদের সঙ্গে আলোচনায় আছে ইউসিবি ব্যাংকের পরিচালক পারটেক্স গ্রুপের শওকত আজিজ রাসেলের নামও।

জানা যায়, সাধারণত প্রতিটি আন্তর্জাতিক ম্যাচেই টিকিট পায় বিভিন্ন ক্লাব। চলতি এশিয়া কাপেও ক্লাবগুলো টিকিট পেয়েছে। কিন্তু ফাইনালের কোনো টিকিট ঢাকার কোনো ক্লাব পায়নি। অন্য সব ম্যাচে বিসিবির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা রিকুইজিশন দিয়ে টিকিট কেনার সুযোগ পেলেও ফাইনাল ম্যাচে পাননি। বরং বিসিবির প্রধান নির্বাহী সবাইকে ই-মেইল করে কোনো রিকুইজিশন না দেওয়ার কড়া নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু থেমে নেই কালোবাজারিরা। এক কালোবাজারি এরই মধ্যে ৩ লাখ টাকার বিভিন্ন ধরনের টিকিট কিনে ১৫ লাখ টাকায় বিক্রি করে ফেলেছেন বলে বিসিবির কর্মকর্তারাই বলাবলি করছেন। আর এতে বলিষ্ঠ ভূমিকা বিসিবিরই এক পরিচালকের।

ক্রীড়াঙ্গনের খবর, জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা প্রতিটি আন্তর্জাতিক ম্যাচেই চার-পাঁচটি সৌজন্য টিকিট পেয়ে থাকেন। এর বাইরে প্রয়োজনে বিসিবি থেকেও কিনতে পারেন। কিন্তু ফাইনাল ম্যাচের চাহিদামতো টিকিট পাননি খোদ জাতীয় দলের খেলোয়াড়রাও। বিসিবি থেকে ২৫ থেকে ৩০টি টিকিট আলাদা করে কিনতে চেয়েও পাননি মুশফিকুর রহিম। ১৫ থেকে ২০টি টিকিট চেয়েছিলেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। খালেদ মাহমুদ সুজন খেলোয়াড়দের হয়ে বিসিবির টিকিট চেয়েছেন। কিন্তু বিসিবির সাড়া না পেয়ে খেলোয়াড়দের কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারেননি জাতীয় দলের ম্যানেজার।

টিকিটপ্রত্যাশী-পুলিশ সংঘর্ষ : গতকাল সকালে মিরপুর-১০ সেকশনে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের (ইউসিবিএল) সামনে ফাইনাল খেলার টিকিটপ্রত্যাশীদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে পুলিশের। এতে আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। ঘটনাস্থল থেকে কয়েকজনকে আটক করেছে পুলিশ। উত্তেজিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কয়েকটি কাঁদুনে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করলে টিকিট বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়। চার ঘণ্টা পর বিক্রি শুরু হলেও এক ঘণ্টায় শেষ হয়ে যায় সব টিকিট। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ওই এলাকায় পুলিশের বিপুলসংখ্যক সদস্য ও সাঁজোয়া যান মোতায়েন করা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, এশিয়া কাপে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে অনুষ্ঠেয় ফাইনাল খেলার টিকিটপ্রত্যাশীরা শুক্রবার থেকে ব্যাংকের সামনে লাইনে দাঁড়ান। গতকাল সকাল ১০টা থেকে ওই ব্যাংকেই টিকিট বিক্রি শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কয়েক হাজার টিকিটপ্রত্যাশীর বিপরীতে টিকিট খুবই কম থাকায় চারদিকে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে তারা ব্যাংকে ইট-পাটকেল ছোড়ে। এতে পুলিশ বাধা দিলে উত্তেজিত টিকিটপ্রত্যাশী জনতা পুলিশকে লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়তে থাকে। একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন তারা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কাঁদুনে গ্যাসের কয়েকটি শেল নিক্ষেপ করে। এ ছাড়া করা হয় লাঠিচার্জ। এতে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় উত্তেজিত জনতা।

ইউসিবির অপর একটি সূত্র জানায়, বেলা ১২টায় টিকিট বিক্রি শুরুর কথা ছিল। কিন্তু বিসিবির পক্ষ থেকে তখন পর্যন্ত টিকিট না পাঠানোয় তা শুরু করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যেই ‘টিকিট নাই’ এবং ‘জাল টিকিট’ বিক্রি হচ্ছে এমন গুজব রটলে টিকিটপ্রত্যাশীদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এরপর বিকাল সোয়া ৪টার দিকে পুলিশের সহায়তায় শুরু হয় টিকিট বিক্রি। এক ব্যক্তিকে শুধু একটি টিকিটই দেওয়া হয় এবং তা শুধু দেড়শ টাকা দামের। টিকিট শেষ হয়ে যায় বিক্রি শুরুর এক ঘণ্টার মধ্যে। ব্যাংক থেকে টিকিট নেই বলে জানানো হয়। এরপর ফের উত্তেজিত হয়ে ওঠেন প্রত্যাশীরা। দ্বিতীয় দফায় পুলিশের সঙ্গে ঢিল-ছোড়াছুড়ি হয় তাদের। তবে এর আগেই লাইনে দাঁড়ানো ব্যক্তিরা টিকিট না পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। তাদের অভিযোগ ছিল, শেষ পর্যন্ত টিকিট পাওয়া যাবে না। এ ঘটনায় আহত কয়েকজনকে আশপাশের হাসপাতালে চিকিত্সা দেওয়া হয়েছে। আটকদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেয় পুলিশ।

মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ভূঁইয়া মাহবুব হাসান বলেন, টিকিট বিক্রি শুরুর আগেই একপর্যায়ে ব্যাংকে ইট নিক্ষেপ এবং সড়কে গাড়ি ভাঙচুর শুরু করেন টিকিটপ্রত্যাশীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ লাঠিচার্জ করে।

তবে এত কিছুর পরও টিকিট পাওয়ার বিজয়ীর হাসি ছিল কারও কারও মুখে। তেমনই একজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাহাত খান। তিনি বলেন, ‘সকাল ৮টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এর মধ্যে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে পায়ে আঘাত পেয়েছি। এর পরও টিকিট তো পেয়েছি!’

সর্বশেষ খবর