মঙ্গলবার, ৮ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

দেশ-বিদেশে সাফল্যের শিখরে বাংলাদেশের নারী

আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস

জিন্নাতুন নূর

দেশ-বিদেশে সাফল্যের শিখরে বাংলাদেশের নারী

নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীরা এখন বিশ্বের কাছে রোল মডেল। দেশ-বিদেশের সব জায়গায় মেধা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে বাংলাদেশি নারীরা সুনাম কুড়াচ্ছেন। সাধারণ পেশার বাইরেও বৈচিত্র্যময় ও চ্যালেঞ্জিং পেশায় অংশগ্রহণের ফলে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে নারীরা এখন বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করছেন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জরিপের ফল বলছে, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের নারীরা এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন। এক দশক আগেও যেখানে দেশে নারীর কর্মসংস্থানে অংশগ্রহণের হার ছিল খুবই কম, এখন নারী কর্মসংস্থানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। অর্থ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান মাস্টার কার্ডের ‘মাস্টার কার্ড ইনডেক্স অব উইমেনস অ্যাডভান্সমেন্ট’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের দুই নারী অ্যাথলেট মাবিয়া আক্তার সীমান্ত ও মাহফুজা খাতুন শিলা ভারোত্তোলন ও সাঁতারে সোনা জয় করে দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনেন। বাংলাদেশের জাতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের সদস্যরাও ধীরে ধীরে নিজেদের অর্জনের পাল্লা ভারী করছেন। ইতিমধ্যেই ওয়ানডে স্ট্যাটাস অর্জন শেষে বর্তমানে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ম্যাচে অন্য পক্ষকে পরাজিত করার মতো সামর্থ্য দেখাতে শুরু করেছেন তারা। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পুলিশ সপ্তাহের প্যারোডে নেতৃত্ব দেন এক নারী পুলিশ। তার নেতৃত্বেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সালাম জানান সহস াধিক পুলিশ। ২৬-২৯ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত পুলিশ সপ্তাহের প্যারোডে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস মাঠে নেতৃত্ব দেন চাঁদপুর জেলার পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার। এ ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবার জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন আইভরি কোস্ট নারী কন্টিনজেন্ট কমান্ডারের নেতৃত্বে ৫৬ সদস্যের একটি মেডিকেল কন্টিনজেন্ট মোতায়েন করা হয়েছে। ২৭ ফেব্রুয়ারি কর্নেল ডা. নাজমা বেগমের নেতৃত্বে দলটি আইভরি কোস্টের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ে।

এদিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নারীরা অনেক দিন ধরে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। কিন্তু এবার সেনাবাহিনীর ইতিহাসে যুক্ত হলো প্রথম দুই নারী পাইলট। তারা হলেন— মেজর নাজিয়া নুসরাত হোসেন ও মেজর শাহরীনা বিনতে আনোয়ার। আকাশজয়ী এ গর্বিত দুই নারী সদস্য গত বছর তেজগাঁও আর্মি অ্যাভিয়েশন গ্রুপে শিক্ষানবিস পাইলট হিসেবে সফলভাবে প্রশিক্ষণ বিমান ‘সেসনা ১৫২ অ্যারোবাট-’এ একক ও দ্বৈত উড্ডয়ন পরিচালনা করেন। নাজিয়া ২০১৫-এর ৭ মে উড্ডয়ন দক্ষতা প্রমাণ করতে প্রথম একক উড্ডয়ন সম্পন্ন করেন। আর শাহরীনা একই বছরের ২১ মে প্রথম একক উড্ডয়ন সম্পন্ন করেন। এর বাইরে টানা এক বছরের কঠিন প্রশিক্ষণ শেষে গত বছরের ২৯ জানুজারি টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে অবস্থিত শহীদ সালাউদ্দিন সেনানিবাসের শহীদ বীরউত্তম প্যারেড গ্রাউন্ডে নিজেদের সমাপনী কুচকাওয়াজে দেশের প্রথম নারী সৈনিক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ৮৭৯ জন নারী। এ ছাড়া দেশে প্রথম নারী ছত্রীসেনা (প্যারাট্রুপার) হিসেবে সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জান্নাতুল ফেরদৌস ২০১২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সফলভাবে ১ হাজার ফুট উঁচু থেকে অবতরণের সম্মান অর্জন করেন। গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশের নারীরা বাণিজ্যিক জাহাজে নাবিক হিসেবে কাজ শুরু করেন, যা বাংলাদেশে প্রথম। আর প্রথম ব্যাচে মোট ১৩ জন নাবিক বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের বিভিন্ন জাহাজে মেরিন অফিসার পদে যোগ দেন। দেশের প্রথম নারী ট্রেনচালক হিসেবে উম্মে সালমা সিদ্দিকা ২০১১ সালে রেলওয়েতে যোগ দেন। তার পথ ধরে বর্তমানে রেল চালনায় যোগ দিয়েছেন ১৫ জন নারী। অটিজম বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। তিনি গ্লোবাল অটিজম পাবলিক হেলথ ইনিশিয়েটিভ ইন বাংলাদেশের জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসন। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অ্যাওয়ার্ড ফর এক্সিলেন্স ইন পাবলিক হেলথ পুরস্কার পান। বাংলাদেশের নারী আলোকচিত্রীদের মধ্যে অনেকেই এখন ভালো করছেন। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী হচ্ছেন তাসলিমা আখতার। সাভারের রানা প্লাজা ধসের শিকার দুই শ্রমিকের আঁকড়ে ধরে থাকা ‘শেষ আলিঙ্গন’ নামের আলোকচিত্রের মাধ্যমে তিনি জার্মানির লিড অ্যাওয়ার্ড পুরস্কার পান। বার্লিনে বর্ষসেরা নারীনেত্রী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন নাজমা আক্তার। প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে এভারেস্টে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছেন নিশাত মজুমদার। দেশের জন্য খ্যাতি ও সম্মান বয়ে আনা অন্য নারী পর্বতারোহী ওয়াসফিয়া নাজনীন। নিশাত মজুমদারের পরপরই তিনি ২০১২ সালে সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় ওঠেন। তিনি ন্যাশনাল জিওগ্রাফির অ্যাডভেঞ্চারস অব দ্য ইয়ার ২০১৪-১৫-এর তালিকায় স্থান পেয়েছেন। এ ছাড়া ওয়াসফিয়া প্রথম বাঙালি হিসেবে দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে উঁচু পর্বত মাউন্ট অ্যাকোনকাগুয়া, উত্তর আমেরিকার ডেনালি, ইউরোপের মাউন্ট এলব্রাস ও অ্যান্টার্কটিকার ভিনসন মাসিফে আরোহণ করেন। দেশের রাজনীতিতে যেমন নারীর সফলতা রয়েছে একইভাবে দেশের বাইরেও আলোচিত নারী হিসেবে লন্ডনের হাউস অব কমনসে প্রথমবারের মতো বাঙালি এমপি নির্বাচিত হন রুশনারা আলী। এ ছাড়া লন্ডনপ্রবাসী বাংলাদেশের টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটেনের স্থানীয় নির্বাচনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি লন্ডনের ক্যামডেন কাউন্সিলের রিজেন্ট পার্ক ওয়ার্ড থেকে লেবার পার্টির টিকিটে নির্বাচিত হন। পাটের জিন আবিষ্কারক প্রয়াত বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের প্রধান সহযোগী ছিলেন ঢাবির অধ্যাপক হাসিনা খান। চ্যালেঞ্জিং প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনেও পারদর্শী নারী। পারসোনার মতো বিশ্বমানের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নারী দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এশিয়ার নোবেল খ্যাত র‌্যামন ম্যাগসাসে পুরস্কার পেয়ে বাংলাদেশের নারীর কৃতিত্বকে বিশ্বদরবারে পরিচিত করিয়েছেন ‘বেলা’র নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। কানাডার নিউ ফাউন্ডল্যান্ডে এসটি জোনস শহরে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব উইমেন পুলিশের ৫০তম বার্ষিক সম্মেলনে ‘আইএডব্লিউপি-২০১২’ পুরস্কারে ভূষিত হন আর এক বাংলাদেশি কৃতী নারী আবিদা সুলতানা। অন্যদিকে বিশ্বখ্যাত নারী উদ্যোক্তার স্বীকৃতি পেয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক সুমাইয়া কাজী। বিশ্বের সেরা প্রভাবশালী ৫০ উদ্যোক্তার তালিকায় ১৬ নম্বরে অবস্থান তার। এ ছাড়া প্রথমবারের মতো দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। বুয়েটের প্রথম নারী উপাচার্য হয়েছেন খালেদা একরাম। দেশে প্রথমবারের মতো ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী জাতীয় সংসদের স্পিকার হিসেবে বর্তমানে সফলভাবে তার দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৩ সালের ১ এপ্রিল নাজমুন আরা সুলতানা দেশের প্রথম নারী বিচারপতি হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। এমনকি দীর্ঘ সময় পরে হলেও দেশের প্রথম নারী ডেপুটি গভর্নর হিসেবে নাজনীন সুলতানা নারীসমাজের কৃতিত্বকে আরো একধাপ বিস্তৃত করেছেন।

আর দুই যুগ ধরে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান এবং বিরোধীদলীয় নেতাও নারী। অর্থাৎ জাতীয় জীবনের সব শাখায় এখন নারীর সফল পদচারণ। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ধীরে ধীরে নারীর ক্ষমতায়ন ঘটছে এ কথা সত্য। তবে আমি মনে করি নারীবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন ও পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলেই নারীর ক্ষমতায়নের পথ আরও প্রশস্ত হবে।’

সর্বশেষ খবর