মঙ্গলবার, ৮ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা
লেখকের অন্য চোখ

ডায়েরির পাতায় ওর নাম কেটে দিলাম

সমরেশ মজুমদার

ডায়েরির পাতায় ওর নাম কেটে দিলাম

সকালে লিখতে বসে পার্থর কথা মনে এলো। বাংলার অধ্যাপক পার্থর স্মৃতিশক্তি  অসাধারণ ছিল। যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের কবিতার কটি লাইন কিছুতেই মনে করতে পারছি না। ওর ‘দূরে দূরে গ্রাম’ কবিতাটি স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। আমি জানি পার্থকে ফোন করলে ও সঙ্গে সঙ্গে বলে দেবে কবিতার নাম, যার একটি লাইনে গোবি সাহারার কথা ছিল। ডায়েরি থেকে পার্থর নম্বর বের করলাম। ল্যান্ড লাইন। আজকাল মোবাইল নম্বরেই ফোন করতে হয়। অনেকেই ল্যান্ড লাইন সারেন্ডার করেছেন মোবাইল ব্যবহার     করার পরে। পার্থর নম্বর ডায়াল করতে গিয়ে দুটি কারণে থমকালাম। প্রথম কারণ, লাইনটি মাথায় হুট করে চলে এলো, ‘একখানি মেঘ এনে দিতে পার গোবি সাহারার বুকে’। কিন্তু আগে পরে কিছুই মনে পড়ছে না। পার্থ অবলীলায় বলে দিতে পারবে। দ্বিতীয় কারণটি একটু অস্বস্তিকর। পার্থকে শেষ ফোন করেছিলাম কবে? দু-চার বছর তো নয়ই, তারও বহু আগে। আজ ফোন করে নিজের সমস্যার কথা বললে ও কি কিছু ভাববে? ভাবতেই পারে। তাহলে আমাকে একটু ভ্যানতারা করতে হবে। করে প্রশ্নটা করাই ভালো।

রিং হচ্ছে। একটু পরে একজন মহিলা রিসিভার তুলে ‘হ্যালো’ বললে আমি সবিনয়ে বললাম, ‘আমি সমরেশ বলছি। পার্থ কি বাড়িতে আছে?’ কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ। তারপর মহিলা বললেন, না নেই। পার্থ দুই বছর আগে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন।

কেঁপে উঠলাম। আচমকা গলার ভিতরে কী একটা আটকাল। দ্রুত রিসিভার নামিয়ে রাখলাম। মিনিট পাঁচেক চোখ বন্ধ করে বসে থাকার পর সোজা হলাম। ভদ্রমহিলা নিশ্চয়ই অবাক হয়েছেন। কিন্তু! আবার ফোন করে কথা বলার কোনো মানে হয় না। পার্থ তার যাবতীয় জ্ঞানভাণ্ডার নিয়ে চলে গেছে। না। চলে গেছে বলাটা সঠিক নয়। কেউ নিজের ইচ্ছেয় যেমন জন্মায় না, তেমনই কোথাও চলে যায় না। যেভাবে আচমকা হাওয়ার ধাক্কায় মোমবাতি নিভে যায়, তেমনই হূদযন্ত্র থেমে যায়। পার্থর ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে। আমি ডায়েরির পাতায় ওর নাম এবং নম্বর কেটে দিলাম। কী সহজে নামটি খারিজ হয়ে গেল ডায়েরির পাতা থেকে। দুই বছর আগে যে মারা গিয়েছিল সে একটু আগে পর্যন্ত আমার কাছে জীবিত ছিল। কৌতূহল হলো। আদ্যাক্ষর ‘এ’ থেকে শুরু করলাম। অনিল মিত্র, আমার স্কুলের সহপাঠী, বহুকাল যোগাযোগ নেই। এখন কি সে বেঁচে নেই। ল্যান্ড লাইনের নম্বরটি ঘোরালাম। কানে এলো, ‘দিস নম্বর ইজ নট একজিস্টিং’। অর্থাত্? নম্বরটি বদলে গেছে। নম্বর বদলে যাওয়া মানে যার নম্বর সে মরে গেছে তা ভাবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু অনিলকে চেনে এমন কেউ কলকাতায় থাকে কিনা জানা নেই। পরিবর্তিত নম্বর খোঁজার চেষ্টা করেও লাভ হলো না। এখন অনিল যদি নিজে আমাকে ফোন না করে তাহলে আর যোগাযোগ সম্ভব হবে না। আর সেটা না হলে জীবিত বা মৃতের মধ্যে তফাত কী থাকল। কিন্তু আর একটি ঘটনা ঘটল। বছর তিরিশেক আগের ডায়েরি পুরনো হয়ে গেলে নতুন ডায়েরিতে নম্বর লিখতে খুব বিরক্ত হতাম। ‘এ’ থেকে শুরু করে ‘জেড’— সব কটি নাম লিখতে হাত ব্যথা হয়ে যেত? হিন্দু বাঙালির নাম জেড দিয়ে সাধারণত হয় না। কিন্তু আমার বন্ধু জুলফিকার কিছুতেই ‘জে’ দিয়ে নামের বানান শুরু করত না। ‘এক্স’-এর পাতা খালি থাকত। মোবাইল এসে যাওয়ায় সেই পরিশ্রম নেই। সেভ আর ডিলিটের সৌজন্যে আসা-যাওয়ার দুই দ্বার খোলা যাচ্ছে সহজেই। আজ কেমন ঘোর লাগল বলে ডায়েরির পাতা ওল্টালাম। স্মৃতি থেকে নামগুলো কাটতে কাটতে অবস্থা এমন দাঁড়াল যে নিজেই শিউরে উঠলাম। এই যে এত মানুষ, যাদের আমি চিনতাম, যাদের কাজে এবং উপদেশে আমি সমরেশ হয়েছি, তারা আজ পৃথিবীতে নেই। আমার স্কুলের মাস্টারমশাইদের প্রায় সবাই চলে গেছেন। আমার কলেজের অধ্যাপকরা : কনক বন্দ্যোপাধ্যায়, গুরুদাস ভট্টাচার্য, বিপিনবাবুরা কবে চলে গেছেন। যে দুজন আছেন, সেই গৌরমোহন মুখোপাধ্যায় এবং আলোক রায়ের কথা ভাবলেই নিজেকে ছাত্র বলে মনে হয়। লিখতে এসে যাদের ছায়ায় ছিলাম সেই বিমল কর, সাগরময় ঘোষ থেকে শুরু করে গজেন্দ্রকুমার মিত্র, সমরেশ বসু, বরেন গঙ্গোপাধ্যায় এখনো স্বপ্নে আসা-যাওয়া করেন। আর যার কাছ থেকে দুই হাত ভরে নিয়েছি, মাঝরাতে লিখতে লিখতে আচমকা আটকে গিয়ে ফোন করে ঘুম ভাঙিয়ে প্রশ্ন করতেই যিনি তথ্য দিয়ে ফোন রাখতেন সেই সন্তোষকুমার ঘোষকে মৃত মানুষ বলে ভাবতে এখনো আমার কষ্ট হয়। কাটতে কাটতে ডায়েরির নামগুলো ক্রমে ছোট হয়ে গেল। হঠাত্? মনে হলো, থাক এটা। ডায়েরিতে নাম তোলা তো বহুকাল বন্ধ করেছি, মোবাইলটি দেখি। ডিলিট টিপতে টিপতে হাত ব্যথা হয়ে যাচ্ছিল। সবাই চলে যাচ্ছেন এক এক করে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে সুনীলদার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তার শরীর খারাপ অথবা মৃত্যুর ছায়া দেখতে পাচ্ছেন, এমন কোনো প্রসঙ্গেই তিনি কথা বলেননি। পঁয়ত্রিশ বছর ধরে যেসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছি, তাই বলতে বলতে আমার মনে হতো, এত শীর্ণ হয়ে গেছেন যিনি, চট করে চেনা মুশকিল যাকে, তিনি জীবনের সব স্বাদ এখনো আগের মতোই পেতে চান। স্বর্গ নিয়ে কথা উঠেছিল। বলেছিলেন, তিনটি কারণে আমি স্বর্গে যেতে রাজি নই। প্রথমত, ওখানে কেউ বই পড়ে না। দ্বিতীয়ত, স্বর্গীয় মদিরায় নেশা হয় না। তৃতীয়ত, স্বর্গের সুন্দরীরা মানবী নয়।

কথাগুলোতে চমক ছিল, আমরা খুশি হয়েছিলাম। একটির পর একটি নাম মুছে ফেলছি মোবাইল থেকে। সেসব প্রিয় নাম যাদের সান্নিধ্যে কত সময় কেটেছে আমার। সন্তোষদার নামটি আসতেই বাক্যটি মনে পড়ে গেল। একজন বললেন,”অনেক ঘুরেছি আমি, এবার মরণের পাশে শুয়ে থাকি। দ্বিতীয় জন চমকে উঠলেন, সর্বনাশ! তাহলে মরণও যে গর্ভবতী হবে। সেই আশি-বিরাশি সালে সন্তোষকুমার ঘোষের বলা কথাগুলো মনে পড়ায় বুঝলাম কেউ কেউ মৃত্যুকেও লীলাসঙ্গিনী হিসেবে ভাবতে পারতেন। যারা গেছেন তাদের নাম মোবাইল থেকে মুছে দিলেই কি তারা চলে যাবেন? তাহলে ভালো কোনো রান্না খেলেই বহুবছর আগে চলে যাওয়া মায়ের মুখ মনে পড়ে কেন? হঠাত্ মোবাইলের বোতামে আঙুল থেমে গেল। ডিলিট করার আগে নামটি দেখলাম। আমার ডাকনাম। এ নামেই নিজের নম্বর সেভ করেছিলাম প্রথম দিকে। এ নামে যারা ডাকতেন তারা সবাই চলে গেছেন। নম্বরটিও মুখস্থ এখন। অতএব ডিলিটে চাপ দিলাম, স্বচ্ছন্দে।

সর্বশেষ খবর