বৃহস্পতিবার, ১০ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

দেশবাসী পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয় ২৩ মার্চ

শরীফ নুরুল আম্বিয়া

দেশবাসী পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয় ২৩ মার্চ

একাত্তরের ১ মার্চ দুপুরের দিকে বেতারে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়ার বরাত দিয়ে ঘোষণা করা হলো পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল পাকিস্তানের ক্ষমতা বাঙালিরা পাবে না। ঢাকাসহ সারা দেশে ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থক ছাড়াও সাধারণ মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। পাকিস্তানপন্থিদের পাকিস্তান রক্ষার ষড়যন্ত্রও ব্যর্থ করতে বাঙালিরা সোচ্চার হলো। বঙ্গবন্ধুর সম্মতিতে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। তার আগে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) গঠিত হয়েছিল, যা স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ হিসেবেও পরিচিত ছিল। বিএলএফের শীর্ষ নেতা ছিলেন সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ। তখন আমি ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের সহসভাপতি এবং বিএলএফ-এর সদস্য। আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি কমিটির জরুরি সভা চলছিল হোটেল পূর্বাণীতে। সেখানে আওয়ামী লীগের এমপিরা আছেন। এদিকে পল্টন ময়দানে মঞ্চ করে মাইক লাগানো হলো। পল্টনে সমবেত হলো বিক্ষুব্ধ মানুষ। মঞ্চ থেকে ইয়াহিয়ার ঘোষণার প্রতিবাদে ২ ও ৩ মার্চ হরতাল ঘোষণা করা হলো। ছাত্র নেতারাসহ সিরাজুল আলম খান, শ্রমিক নেতা আবদুল মান্নান, তোফায়েল আহমেদ বক্তৃতা করলেন। তারা বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা চান। সভায় জনগণকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে চলতে বলা হলো। ১ মার্চের পর পরিস্থিতি পুরো পাল্টে গেল। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রসভায় ৬ দফার সংগ্রাম একদফায় পরিণত হলো। আওয়াজ উঠল : বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। এই স্লোগান বিরোধিতা করার কেউ ছিল না। আগে যারা বিরোধিতা করত তারাও একদফার আন্দোলনে যোগ দেয়। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার ছাত্র জনসভায় যোগ দিল হাজার হাজার মানুষ। মঞ্চ করা হলো কলাভবনের গাড়ি বারান্দায়। চতুর্দিকে শুধু স্বাধীনতার ঘোষণার দাবি। সভার প্রায় শেষ প্রান্তে এসে ডাকসু সভাপতি আ স ম রবের উদ্যোগে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলে ধরল। যা ছিল জয় বাংলা বাহিনীর পতাকা। তুমুল করতালি দিয়ে জনতা এই পতাকা বরণ করে নেয়। সভায় ছাত্রলীগের সব নেতাই উপস্থিত ছিলেন। তোফায়েল আহমেদ এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিচালনার শপথ নিয়ে সভা শেষ হয়। ৩ মার্চ পল্টনে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জনসভা। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে শুরু হলো। সেখানে পাকিস্তানের পতাকা পোড়ানো হলো। বাংলাদেশের নতুন পতাকা (যা ২ মার্চ বটতলায় তোলা হয়েছিল) মঞ্চে উড়ছিল। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পড়লেন। ইশতেহারে ঘোষণা করা হলো— ‘বাঙালির জাতীয় রাষ্ট্রের নাম হবে বাংলাদেশ, দেশ হবে বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক, পাকিস্তানিরা দখলদার, মুক্তি সংগ্রামের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, জাতীয় সংগীত হবে, আমার সোনার বাংলা’ ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধু সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করলেন। বললেন, সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে, তিনি অগ্নিসংযোগ ও নাশকতা সম্পর্কে সাবধান থাকতে বললেন এবং অসহযোগের ডাক দিলেন। বঙ্গবন্ধু তার ওপর আস্থা রাখতে বললেন। ৪-৬ মার্চ পর্যন্ত অর্ধ দিবস হরতাল দিলেন। ২, ৩ মার্চ সন্ধ্যার পর কার্ফু দিয়েছিল সরকার, গুলিতে অনেকে শহীদ হয়েছিল সারা দেশে, এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়েছিল। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন, স্বাধীনতার ডাক দিলেন, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বললেন। বললেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। সার্বিক অসহযোগের ডাক দিলেন আর সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফেরত নিতে বললেন। ৭ মার্চের ভাষণের পর বিএলএফ-এর (স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ) কাজে গতি সঞ্চার হয়। অনিয়মিত যুদ্ধের সামর্থ্য বাড়ানোর জন্য অস্ত্র গোলাবারুদ ভাণ্ডার বাড়ানোর জন্য অস্ত্রের দোকান, কেমিক্যালের স্টোর টার্গেট করা হলো। এগুলো সংগ্রহ এবং মজুদ করা কঠিন ছিল। রোজই রাইফেল, বন্দুক আমার রুমে জমা হতে থাকল, পরে তা বিভিন্ন জায়গায় স্থানান্তরিত হতো। বোমা বানানো, ট্যাংক সাঁজোয়া গাড়ির আক্রমণ স্লথ করে দিতে মেকানিক্যাল ডিভাইস বুয়েট ওয়ার্কশপে তৈরি হতো। ছোট রেডিও স্টেশন চালু করার প্রচেষ্টা, ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন সিস্টেম চালুর চেষ্টা হয়েছিল, তবে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমরা তা করে উঠতে পারিনি। অধ্যাপক নুরুল্লার একটা দল এ কাজে নিয়োজিত ছিলেন। সিরাজ ভাই (সিরাজুল আলম খান) আমার মাধ্যমে এসব কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত হতেন। ৭ মার্চের পর বেসামরিক প্রশাসন ভেঙে পড়তে লাগল। ব্যাংক, সরকারি অফিস বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলত। জেলখানা ভেঙে কয়েদিরা বের হতে থাকল। ঢাকা জেল, বরিশাল জেল, নারায়ণগঞ্জ জেল একে একে ভেঙে পড়ল। পরিস্থিতি যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায় এবং স্বাধীনতার লক্ষ্যে প্রস্তুতি অগ্রসর করার জন্য সংগ্রাম পরিষদ সারা দেশে, এলাকায়-এলাকায় ১০ সদস্যবিশিষ্ট সংগ্রাম কমিটি করার সিদ্ধান্ত দিল ৬ তারিখেই। অলি আহাদ, আতাউর রহমান, মওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধু মুজিবকে সমর্থন করলেন। ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন ইয়াহিয়ার নির্যাতনের তীব্র প্রতিবাদ করলেও, স্পষ্টভাবে স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিতে পারেনি তাদের পাকিস্তানভিত্তিক সাংগঠনিক কাঠামোর জন্য, ওয়ালি খানের ওপর তারা অনেক নির্ভর করতেন। ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ আবার জাতীয় পরিষদ অধিবেশন ডাকলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, সংগ্রামী জনতার রক্ত মাড়িয়ে তিনি অধিবেশনে যাবেন না, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে, হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার করতে হবে। কিন্তু গ্রহণযোগ্য তদন্ত কমিটি হলো না। ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ ঢাকায় এলেন আলোচনার জন্য, বাংলার রাজনীতিতে পাকিস্তানপন্থিরা আবার সক্রিয় হয়ে উঠলেন। জনগণ প্রাসাদ রাজনীতির গন্ধ পেল। ১৬ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত আলোচনা চলল। কোনো ফলাফল নেই, কেননা সময় ক্ষেপণ ছিল তাদের লক্ষ্য। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি সক্রিয় হয়ে উঠল। ১৮ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন অভিমুখে মিছিল শুরু হলো, প্রতিদিন তা বাড়তে লাগল। ২২ মার্চ শত শত মিছিল বঙ্গবন্ধু ভবনে এলো। ১৯ মার্চ জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে বাঙালি সৈনিকদের নিরস্ত্র করতে গিয়ে সংঘর্ষে প্রায় ২২ জন মারা যায়। ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবস। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয়, এই দিন পাকিস্তান প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করা হবে। সারা দেশে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ানো হবে, জয় বাংলা বাহিনী মার্চপাস্ট করে বঙ্গবন্ধু ভবনে যাবে। ২২ মার্চ গভীর রাত থেকেই এই কাজ শুরু হয়ে যায়। ২৩ মার্চ দৈনিক পত্রিকায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার ছবি ছাপানো হয়। ২৩ মার্চ সকাল থেকেই স্বাধীন বাংলার পতাকায় সয়লাব হয়ে যায় সারা দেশ। বাস্তবে পাকিস্তানের কফিনে একাত্তরের ২৩ মার্চ শেষ পেরেকটি ঠুঁকে দিয়েছিল এ দেশের মানুষ।

সর্বশেষ খবর