বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

ষড়যন্ত্র ছিল রিজার্ভ তছনছের

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

বাংলাদেশের শক্তিশালী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর নজর ছিল আন্তর্জাতিক চক্রের। দীর্ঘ সময় নিয়ে তারা দেশের রিজার্ভের মজুদ বৃদ্ধির ওপর নজর রাখছিল। এরপর ওই চক্রটি যে ষড়যন্ত্রের ছক সাজিয়েছিল সেটি পুরোপুরি সফল হলে তছনছ হয়ে যেত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ। ৩৫টি অ্যাডভাইসে হ্যাকার চক্রটি দেশের প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা) হাতিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। তবে একটি ভুল, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সতর্কতা আর ফেডারেল রিজার্ভের সন্দেহের কারণে ওই ষড়যন্ত্র পুরোপুরি সফল করতে পারেনি হ্যাকার চক্র। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তদন্তে নিয়োজিত আইটি বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন, রিজার্ভ চুরির জন্য পুরো পরিকল্পনাটি এত সূক্ষ্ম ও সমন্বিত ছিল যে, এটিকে আর নিছক হ্যাকারদের কার্যক্রম বলে মনে হচ্ছে না। এই ঘটনার সঙ্গে আন্তর্জাতিক কোনো চক্র জড়িত বলে তারা মনে করছেন, যাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল রিজার্ভ ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলা।

গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ধারণা, বিপুল পরিমাণ রিজার্ভ চুরি করে দেশের অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করার জন্য পরিকল্পিতভাবে এই কাজটি করা হয়েছিল। কারণ অর্থনীতির এই অভিঘাত দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকেও টালমাটাল করে দিতে পারত। এ থেকে ওই আন্তর্জাতিক চক্রটি দুইভাবে লাভবান হতো। এক, এতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা তাদের হাতে চলে যেত। দুই, ওই অর্থে বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করা যেত। তবে পুরো পরিকল্পনা সফল না হওয়ায় সেটি সম্ভব হয়নি। সূত্রগুলো আরও জানায়, রিজার্ভের অর্থ ব্যবহার করে দেশে জঙ্গি তত্পরতা বাড়ানোর বিষয়টিও গোয়েন্দাদের সন্দেহের মধ্যে রয়েছে। কারণ, দেশে জঙ্গি কার্যক্রম ছড়িয়ে দিতে এর আগেও ব্যাংক লুটের মতো ঘটনা ঘটেছে। তবে এবারের এই পরিকল্পনার পেছনে ছিল আন্তর্জাতিক চক্র। যার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে বিভিন্ন দেশের একাধিক রাজনৈতিক শক্তি, যারা রিজার্ভকে তছনছ করে দেওয়ার মতো একটি ভয়াবহ পরিকল্পনা সাজিয়েছিল। রিজার্ভ চুরির একটি অংশ প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার পাঠানো হয় শ্রীলঙ্কার একটি এনজিওর নামে। তবে হ্যাকাররা ওই এনজিওটির নামের বানান ভুল করায় দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই টাকা আটকে দেয়। ফলে বিষয়টি দ্রুত নজরে আসে সংশ্লিষ্টদের। যদি ধরা না পড়ত তবে ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংকে পাঠানো ৮১ মিলিয়ন ডলারের মতো এই অর্থও চলে যেত চক্রটির কাছে।

সূত্রগুলো জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য পদত্যাগী গভর্নর ড. আতিউর রহমান শুরুতেই ঘটনাটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবহিত করেছিলেন। ফলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এ বিষয়ে তাদের নিজস্ব তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছিল। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে সরকারের অনেকেই বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। এদিকে আইটি বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমেও হ্যাককৃত অর্থ ফেরত আনা এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন ড. আতিউর। বিষয়টি নিয়ে যাতে কোনো ধরনের আতঙ্ক তৈরি না হয় সে কারণেই এ বিষয়ে কিছুটা গোপনীয়তা বজায় রাখতে চেয়েছিলেন তিনি।

সুইফট কোড (অর্থ স্থানান্তরের গোপন সংকেত) ব্যবহার করে হ্যাকাররা যে ৩৫টি অ্যাডভাইস পাঠিয়েছিল নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে, সেখান থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ৫টি অ্যাডভাইস কার্যকর হওয়ায় ১০১ মিলিয়ন ডলার হ্যাক হয়ে যায়। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কায় একটি এনজিওর নামে পাঠানো হয় ২০ মিলিয়ন ডলার। বাকি ৮১ মিলিয়ন ডলার যায় ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকে। তবে এনজিওটির নামের বানান ভুল করায় শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক আটকে দেয় সেই টাকা। এর পরপরই বাংলাদেশ ব্যাংক ওই অর্থ উদ্ধারে কার্যক্রম শুরু করে। একই সঙ্গে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংককেও হ্যাককৃত অর্থ ছাড় না করার অনুরোধ জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ফিলিপাইনের ওই ব্যাংকটির কর্মকর্তারা সেই অনুরোধ না রেখে তড়িঘড়ি করে অর্থ ছাড় করে দেয়। এরপর বিষয়টি ফিলিপাইনের ডেইলি ইনকোয়ারের প্রতিবেদনে উঠে এলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ৯ মার্চ বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়।

আইটি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনো পর্যন্ত যে তথ্যগুলো তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, সুইফট কোড ব্যবহার করে জিরো আওয়ারে রিজার্ভ স্থানান্তরের অ্যাডভাইসগুলো পাঠানো হয়েছিল। ৪ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত ১২টার কাছাকাছি সময়ে এই ঘটনাটি ঘটে। এরপর ছিল শুক্র ও শনিবার যা বাংলাদেশে সরকারি ছুটির দিন। আর রবিবার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ছুটির দিন। ফলে পুরো তিন দিন হাতে সময় নিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে ঘটনাটি ঘটানো হয়েছিল। এ ছাড়া ঘটনার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট কোডের লেনদেন সংক্রান্ত তথ্য প্রেরণকারী কম্পিউটারের প্রিন্টারটি কাজ করছিল না। অর্থাৎকোনোভাবে বিষয়টি যাতে ধরা না পড়ে সে ব্যাপারে আগেভাগেই প্রতিরোধকমূলক উদ্যোগ নিয়ে রেখেছিল ওই চক্রটি। টেকনিক্যাল এসব ঘটনার পাশাপাশি পারিপার্শ্বিক আরও কিছু ঘটনাকে সংযুক্ত করে পুরো বিষয়টিকে একটি আন্তর্জাতিক চক্রের পরিকল্পনা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা, যে পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল দেশের রিজার্ভ ব্যবস্থাকে ভেঙে দেওয়া।

সর্বশেষ খবর