শুক্রবার, ১৮ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

মাদকাসক্তি নিরাময়ে একজন বিদেশির ‘আপনগাঁও’

কাবুল উদ্দিন খান, মানিকগঞ্জ

মাদকাসক্তি নিরাময়ে একজন বিদেশির ‘আপনগাঁও’

মাত্র ২৫ বছর বয়সে বাংলাদেশে এসেছিলেন ব্রাদার রোনাল্ড ড্রাহোজাল। কর্মজীবন শুরু করেছিলেন শিক্ষকতা দিয়ে। অবসরও নেন এই শিক্ষকতা পেশা থেকেই। এরপর জীবনের শেষ সময়টুকু কাটাতে চেয়েছিলেন নিজের জন্মস্থান-যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু পারেননি। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে ঢাকার মোহাম্মদপুর ছেড়ে যাওয়ার প্রাক্কালে এক মাদকাসক্ত প্রতিবেশীর অকাল মৃত্যু পাল্টে দিল তার গন্তব্য। মাদকাসক্তদের জন্য কিছু একটা করতে চাইলেন এই ভিনদেশি নাগরিক।

আর সেই চাওয়া থেকেই থেকে গেলেন বাংলাদেশে। প্রতিষ্ঠা করলেন মাদকাসক্ত মানুষের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র 'আপনগাঁও'। ব্রাদার রোনাল্ড ড্রাহোজাল-এর মতে, ঈশ্বরের নৈকট্য লাভ করতে হলে মানবসেবা করতে হয়। আর সে কারণেই তিনি মাদকাসক্তদের নিয়ে কাজ করছেন। নিজের কাজ নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এই বিদেশি আরও বলেন, 'ঈশ্বরকে কাছে পাওয়ার জন্যই সবকিছু ছেড়ে মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আমার কাছে কোনো ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ আলাদা কিছু নয়। সব মানুষের জন্যই কাজ করতে চাই।' তিনি বলেন, 'পরিচয়হীন শিশুরা যেহেতু বেশি অবহেলিত, যেহেতু তারা অসুস্থ হলে চিকিৎসার সুযোগ নেই, সে কারণেই তাদের নিয়ে বেশি কাজ করছি। আমি আসক্ত ব্যক্তির করুণ মৃত্যু দেখেছি। তাই চাই না আর কোনো ব্যক্তি অকালে ঝরে পড়ুক।' নিরাময় কেন্দ্রের কাউন্সিলর জুয়েল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ১৯৯৪ সালের ১ অক্টোবর ১৩ দশমিক ১৬ একর জায়গা নিয়ে আপনগাঁও নিরাময় কেন্দ্রটি গড়ে তুলেন ব্রাদার রোনাল্ড ড্রাহোজাল। তবে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলায় স্থাপিত আজকের আপনগাঁও একদিনে তৈরি হয়নি। ১৯৮৮ সালে ঢাকার মোহাম্মদপুরে ইকবাল রোডে প্রথম এই প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে। কিছুদিন এর কার্যক্রম ছিল সেখানকার শাহজাহান রোডে। কিন্তু ক্রমান্বয়ে যখন প্রতিষ্ঠানটির পরিসর বাড়তে থাকে তখন ক্ষুদ্র পরিসরে বিঘ্নিত হয় এর সেবা কার্যক্রম। সমস্যা সমাধানে ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার জাইল গ্রামে 'আপন' এর জন্য তিন একর জমি কেনেন ড্রাহোজাল। 'একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি অসুস্থ, সে পাগল বা খারাপ নয়'- এই স্লোগানকে হূদয়ে ধারণ করে ২০০৭ সালে গড়ে ওঠে তার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান-আপন আসক্তি পুনর্বাসন নিবাস। সবার ভালোবাসায় এই 'আপন'-এর নাম মুখে মুখেই হয়ে যায় 'আপনগাঁও'। আপন আসক্তি পুনর্বাসন নিবাস থেকে চিকিৎসা সেবা নিয়ে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ২৮ জন মাদকাসক্ত ব্যক্তি  ফিরে পেয়েছেন স্বাভাবিক জীবন। তাদের অনেকেই এখন কর্মক্ষেত্রে দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে এই নিরাময় কেন্দ্রে ১৩০ জন মাদকাসক্ত চিকিৎসা নিচ্ছেন।  দুই দিন আগেও সরেজমিন দেখা যায়, আসক্ত শিশুদের নিয়ে ব্রাদার ড্রাহোজাল বাসেড়ট বল খেলছেন। সাংবাদিক জেনে খুব আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসে ওইসব শিশু। মাদকাসক্তরা কথা বলেন নিজেদের অতীত কর্ম নিয়ে। তারা প্রত্যেকেই বিভিন্ন নেশার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিন্তু আপনগাঁওয়ে চিকিৎসা সেবা নিয়ে এখন অনেকটা ভালো আছেন তারা। ব্রাদার ড্রাহোজালের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানে চিকিৎসার পাশাপাশি নিয়মিত লেখাপড়া, খেলাধুলা, হাতের কাজ শেখাসহ পিতৃস্নেহে বড় হচ্ছে মাদকাসক্তরা। রোনাল্ড ড্রাহোজাল ১৯৩৭ সালে ১৪ নভেম্বর আমেরিকার আইওয়া শহরে জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি "্বিতীয়। ১৯৬৩ সালে ঢাকায় সেন্ট গ্রেগরি সড়ুলে শিক্ষকতা পেশা দিয়ে বাংলাদেশে কর্মযাত্রা শুরু করেন। থাকতেন মোহাম্মদপুরে। এরপর সেন্ট নিকোলাশ সড়ুল এবং সেন্ট যোসেফ সড়ুলে শিক্ষকতা শেষে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর নিয়ে তিনি নিজ দেশ আমেরিকা যাওয়ার সি"ান্ত নেন। যাওয়ার প্রাক্কালে ঢাকার মোহাম্মদপুর নিবাসী প্রতিবেশী হেরোইনসেবী এক ব্যক্তির অকাল মৃত্যু হয়। এই মৃত্যু তাকে দারুণভাবে ব্যথিত করে। তখনই মানবদরদি রোনাল্ড ড্রাহোজাল বাংলাদেশের মাদকাসক্তদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য এ দেশেই থেকে যান। এ ছাড়া ছোটবেলা থেকেই এই বিদেশি স্বপ্ন দেখতেন মানুষের জন্য কিছু করার।

সর্বশেষ খবর