শিরোনাম
রবিবার, ২০ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিদ্রোহী সেনারা গ্রামে এসেছে দেখে স্লোগান দিলাম ‘জয় বাংলা’

মঈন উদ্দীন খান বাদল

বিদ্রোহী সেনারা গ্রামে এসেছে দেখে স্লোগান দিলাম ‘জয় বাংলা’

একাত্তরের মার্চের গোড়ার দিকে ঢাকায় ছিলাম। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সময় মঞ্চ পাহারায় যে স্বেচ্ছাসেবক দল ছিল, সেই দলেরও একজন ছিলাম আমি। তৎকালীন ইকবাল হলের মাঠে সমর প্রস্তুতি হিসেবে যে সামরিক ট্রেনিংয়ের চেষ্টা চলছিল আমি তাতেও অংশ নিই। ১০ মার্চের মধ্যেই কোনো একসময় আমাদের রাজনৈতিক নেতা সিরাজুল আলম খান ডেকে বললেন, তুমি এলাকায় ফিরে যাও, সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নাও। এখানে আলোচনা যাই হোক, এ আলোচনায় কিছুই হবে না। পাকিস্তানিদের সঙ্গে আপসের আর কোনো জায়গা নেই। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনেক কাগজপত্র নিয়ে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী গেলাম। অনেক সিভিল গান (বন্দুক) সংগ্রহ করলাম। এ সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরিরত একজন ল্যান্সনায়েক বিয়ে করার জন্য ছুটি নিয়ে গ্রামে এসেছিলেন। আমরা তার কাছে সামরিক প্রশিক্ষণ নিলাম। যুদ্ধের শুরুতে এই প্রশিক্ষককে পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করে। আমরা যখন ট্রেনিং নেওয়া শুরু করি, তখন ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের সংলাপ চলছিল। কিন্তু আমি তখন আমার দলবল, যুব-ছাত্র কর্মীসহ এলাকায় এ প্রচারণা জোরদার করছি যে, ‘স্বাধীনতার জন্য লড়াই হবে’। আমরা জানতে পারলাম, ঢাকা থেকে ওয়াপদার একটি জিপ গাড়ি নিয়ে একজন চালক বোয়ালখালী এসেছেন। আমরা এ জিপটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বাংলাদেশের পতাকা টানিয়ে সারা বোয়ালখালী ঘুরিয়েছি। তবে সবচেয়ে বড় যে ঘটনাটি আমার জীবনে ঘটেছে (তা আমি সংসদেও বলেছি) ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে আমরা সবাই সংঘবদ্ধ হয়ে এক জায়গায় থাকতাম। সেখানে এসে আমার এক দরিদ্র কৃষক আত্মীয় কাক-ভোরে আমাকে ডেকে বললেন, তিনি জমিতে হালচাষ করতে গিয়ে দেখতে পেয়েছেন সেনাবাহিনী আসছে। আমি দেখতে পেলাম বহু দূরে পিপীলিকার মতো তিন-চারটি সারিতে বহু লোক আসছে। তখন আমার মনে হলো, এরা পাকিস্তানি সৈনিক নয়, বাঙালি। দলটি ধীরে ধীরে আমাদের কাছে এসে পৌঁছল। দেখলাম অনেক লোক, সামরিক পোশাক পরা। কারও কাঁধে একটি, কারও কাঁধে দুটি রাইফেল। তারা সবাই ক্লান্ত। ২৬ মার্চে প্রচণ্ড কুয়াশা ছিল। তারা যখন কাছাকাছি তখন আমরা বন্দুক উঁচিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে চিৎকার দিতে থাকি। আমরা যখন স্লোগান দিচ্ছিলাম তখন ওই সামরিক পোশাক পরা লোকগুলো মাটিতে শুয়ে পড়ে পজিশন নেয়। তখন আমি আমার সহকর্মীদের রেখে একাই হাঁটতে হাঁটতে ওদের দিকে অগ্রসর হই। তখন তারা দাঁড়িয়ে যায়। আমার মনে আছে, কাছাকাছি গিয়ে তাদের মধ্যে প্রথম যার সামনাসামনি হলাম তিনি বয়স্ক সৈনিক। তার কাপড়ে রক্তের দাগ। তার গোঁফ প্রায় সাদা হয়ে গেছে। ওই বয়স্ক সৈনিক আমায় জড়িয়ে ধরে উর্দুকে বললেন, ‘শের কে বাচ্চা, তুম লোক বি হাতিয়ার লেলিয়া, বাংলা আজাদ হো গিয়া’। আমি তাকে বললাম, আপনার অফিসার কোথায়। তিনি জানান, অফিসার পেছনে। একটু পরই এক অফিসারের সঙ্গে দেখা। তিনি নিজের পরিচয় দিলেন ‘ক্যাপ্টেন হারুন’। এই হারুন পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হয়েছিলেন। আমি নিজের পরিচয় দিলাম। বললাম, আমি ছাত্রলীগের একজন নেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। উনি প্রশ্ন করলেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ আছে? বললাম, হ্যাঁ, আছে। তখন বললেন, ‘আপনি বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে দিন অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্ট রিভোল্ট করেছে। মেজর জিয়া, মেজর মীর শওকত আলীসহ আমরা রিভোল্ট করেছি।’ চট্টগ্রাম, কাপ্তাইসহ তিনটি স্থান থেকে হেঁটে আসা ক্লান্ত এই সৈনিকদের জন্য আমরা গ্রামবাসীর সহযোগিতায় খাবারের ব্যবস্থা করি। গ্রামের প্রতিটি মানুষ নিজেদের সকালবেলার নাস্তা নিয়ে আসেন এই সৈনিকদের জন্য। তারা যখন সকালের নাস্তা করছেন, তখনই আকাশে উড়ন্ত বিমান দেখা গেল। মেজর জিয়াসহ অন্যরা বললেন, ‘খোলা জায়গায় থাকা আমাদের জন্য নিরাপদ নয়।’ আমরা তাদের পাহাড়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করলাম। কানুনগোপাড়া কলেজের পেছনে যষ্টুপাড়া পাহাড়ে তারা অবস্থান নিলেন। এর আগে মেজর জিয়া, মেজর মীর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন হারুনদের সঙ্গে আমার কথা হলো। তারা পাহাড়ের দিকে চলে যাওয়ার কিছু পরে আমরা রেডিওতে শুনতে পেলাম চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতা এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা করছেন। এটা ২৬ মার্চ দিনের কথা। আমরা সৈনিকদের পাহাড়ে পাঠিয়ে দেওয়ার পর বিকালের দিকে দেখলাম সবুজ রঙের ভক্সওয়াগনে করে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতা চক্ষুবিশেষজ্ঞ ডা. জাফর, আতাউর রহমান কায়সার, হাটহাজারীর এমএনএ ওহাব এলেন। তারা বললেন, আমরা শুনেছি বাঙালি সৈন্যরা এদিকে এসেছেন। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। মেজর জিয়াউর রহমানসহ অন্য যারা আছেন তাদের সঙ্গে ২৬ মার্চ বিকালেই পাহাড়ে নেতাদের কথা হয়। নেতারা সৈনিকদের খোঁজার কারণ ব্যাখ্যা করে বললেন, আমরা রেডিওতে ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছি। কিন্তু আমরা মনে করি যদি সামরিক বাহিনীর একজন অফিসার রেডিওতে এ ঘোষণাটি দেন তাহলে সামরিক বাহিনীতে প্রতিরোধের প্রশ্নে আরও বেশি শক্ত অবস্থান তৈরি হবে। নেতাদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে জিয়া বললেন, তিনি ঘোষণা দেবেন। এর পরের ঘটনা সবাই জানেন। ২৭ মার্চ সেই কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এ ঘোষণার বিষয়ে একটি কথা বলব, প্রথম ঘোষণা যেটি তিনি নিজে লিখেছেন তাতে তিনি নিজেকে সেনাবাহিনীর প্রধান, আন্দোলনের প্রধান দাবি করে ঘোষণা দেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা তার প্রথম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত বুঝতে পারেন, এ রকম একটি ঘোষণা সব আন্দোলনকে বিকৃত করে দেবে। আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, কোনো অবস্থাতেই এটা সিচুয়েশন ইন মুভমেন্ট নয়। এটা জনগণের স্বাধিকারের আন্দোলন। তখন হান্নান সাহেবের দেওয়া ঘোষণাটি নতুন করে লিখে মেজর জিয়া আবার ঘোষণা দেন। যেটি এখন আর্কাইভে আছে। স্বাধীনতার ঘোষণাটি হয়েছে ২৬ মার্চ। এ কারণে আমাদের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ। আর জিয়াউর রহমান ২৬ মার্চ সারা দিন চট্টগ্রাম শহরেই পৌঁছেননি। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তিনি যে ঘোষণা দিয়েছেন তা ২৭ মার্চ।

সর্বশেষ খবর