কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতার নিষ্ক্রিয়তা আর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কারণে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের তুখোড় সেই ছাত্রনেতারা বিএনপিতে আজও কোনঠাসা। দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলেও তারা ছিলেন একেবারে দর্শক। ২০১৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর চেয়ারপারসনের সামনে সারা দেশ থেকে আগত ছাত্রদলের জাতীয় কনভেনশনে শপথ গ্রহণ হয়। এরপর কতিপয় স্বার্থান্বেষী নেতার নিষ্ক্রিয়তা আর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কারণে আন্দোলনে অন্য ত্যাগী নেতাদের অবদান ম্লান হয়ে যায়। এর ফলে বিএনপির নানা স্তরে কমিটি গঠনের প্রক্রিয়ায়ও তার প্রভাব পড়ে। এবারও সেই ধারাবাহিকতায় কাউন্সিলে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র— সব ক্ষেত্রে ত্যাগী সেই ছাত্রনেতারা উপেক্ষিত হতে পারেন।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, দু-এক জন শীর্ষ নেতার সাম্প্রতিক বিএনপি রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়তা ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এসব বিতর্কিত নেতার বিশ্বাসভঙ্গের কারণে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও এখন অনেকটাই হতাশ ও বীতশ্রদ্ধ। নব্বইয়ের পর যাদের তিনি বিশ্বাস করে বার বার এমপি-মন্ত্রী বানিয়েছেন, বসিয়েছেন দলের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে; বিগত আন্দোলনে তাদের ভূমিকায় চরম হতাশ ও রীতিমতো ক্ষুব্ধ হয়েছেন খালেদা জিয়া। ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনের আগে-পরের আন্দোলন ছাড়াও বিশেষ করে ২০১৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ছাত্রদলের জাতীয় কনভেনশনে সারা দেশ থেকে আগত ছাত্রনেতাদের আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য ‘অগ্নিশপথ’ বাক্য পাঠ করানোর পরদিন থেকে নব্বইয়ের আন্দোলনের জনৈক নেতার গাঢাকা দেওয়ার ঘটনায় বেগম জিয়া মনঃক্ষুণ্ন হন। আর সারা দেশের নেতা-কর্মীরা হন চরম হতাশ। জানা গেছে, ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাস গুলশানের নিজ কার্যালয়ে অবরুদ্ধ থাকাবস্থায় সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে নব্বইয়ের সেই প্রিয় ছাত্রনেতাদের কাছে একটু বেশিই আশা করেছিলেন খালেদা জিয়া। নেতৃত্বে থাকা হাতে গোনা কয়েকজন বিতর্কিত নেতা ছাড়া বাকি নেতারা মোটামুটি সক্রিয় ছিলেন। বিশেষ করে তত্কালীন ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক (জিএস) খায়রুল কবির খোকনের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। রাজধানীর অদূরে নরসিংদী জেলায় প্রতিদিন তার সভা-সমাবেশের চিত্র ছিল লক্ষণীয়। তারই সহধর্মিণী শিরিন সুলতানা বিএনপি-প্রধানের সঙ্গে গুলশানের কার্যালয়ে ছিলেন তিন মাস অন্তরীণ। তার সহপাঠীরা বার বার এমপি-মন্ত্রিত্বসহ দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হলেও তিনি এখনো সেই তিমিরেই রয়ে গেছেন। অন্যদিকে ৫ জানুয়ারির আগে-পরের আন্দোলনে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর টকশোয় মন্ত্রিসভা থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সমালোচনার ঝড় তুলে সর্বশেষ ২০১৫ সালের প্রথমার্ধের এক মধ্যরাতে একটি টেলিভিশন স্টেশন থেকে গ্রেফতার হন নব্বইয়ের তুখোড় ছাত্রনেতা হাবিবুর রহমান হাবিব। তিনি এখনো দলের সেই সহতথ্য ও গবেষণা সম্পাদক। জাতীয় প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন স্থানে সভা-সেমিনারসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রতিদিনই যথাসম্ভব ঝুঁকি নিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছেন মুস্তাফিজুর রহমান বাবুল ও তার অনুসারীরা। বাবুল নির্বাহী সদস্যই রয়ে গেছেন। দলের নির্বাহী সদস্য আজিজুল বারী হেলাল, শফিউল বারী বাবু, আমিরুল ইসলাম খান আলীম, আবদুল বাতেন শামীম, স্বেচ্ছাসেবক দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম পুটু সুযোগ পেলেই সঙ্গীয় কর্মীদের নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঝটিকা মিছিলের আয়োজন করেছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্নভাবে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করলেও অর্থ ও সম্পদের পাহাড় গড়া দু-এক জন নেতার বিশ্বাসভঙ্গের কারণে তাদের সব অবদান ম্লান হয়ে যায়। সাইফুল ইসলাম পুটু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে ছাত্রদলের কনভেনশনে শপথ পড়িয়ে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়ার পরে আর সেই শীর্ষ নেতাদের রাজপথ তো দূরের কথা, কোথাও কেউ খুঁজে পাইনি। এমনকি তাদের মোবাইল ফোন পর্যন্তও বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। ফলে তারা তখন কেন্দ্রীয় কমান্ড ছাড়াই নিজেদের মতো করে আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। মামলা-হামলার শিকার হয়েছেন। পুটুর মতো ছাত্রদলের এমন শতাধিক সদস্য রয়েছেন যারা আজ পর্যন্ত মূল দলেই প্রবেশ করতে পারেননি। এ ছাড়াও দলের সাবেক নির্বাহী সদস্য কামরুজ্জামান রতন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক (১৯৯০) আবদুল মালেকসহ আরও অসংখ্য নেতা রয়েছেন যাদের কোনো মূল্যায়ন করা হয়নি। নব্বইয়ের আন্দোলনে অসামান্য ভূমিকা রাখলেও বর্তমানে দলে তার কোনো পদবি নেই। তবে আশির দশকের ছাত্রনেতা শামসুজ্জামান দুদু ও ড. আসাদুজ্জামান রিপনের এই বয়সের ভূমিকায়ও সন্তুষ্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। দলের আসন্ন নতুন নির্বাহী কমিটি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপি নেতা হাবিবুর রহমান হাবিব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাজনীতিতে যারা মামলা-হামলা, নির্যাতন স্বীকার করে ঝুঁকি নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবেন এমন সাহসীদেরই বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে নেওয়া উচিত। বিশেষ করে বর্তমান ‘অস্বাভাবিক’ প্রকৃতির সরকারের আমলে বিরোধী দলের ওপর চলমান দমননীতিকে মেনে নিয়েই যারা রাজপথে থাকবেন তাদেরই দায়িত্ব দেওয়া উচিত। নব্বইয়ের ছাত্রনেতা মুস্তাফিজুর রহমান বাবুল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অপেক্ষাকৃত সৎ, সাহসী, দেশপ্রেমিক ও দলের ইমানি পরীক্ষায় উত্তীর্ণদেরই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব দেওয়া উচিত। বিশেষ করে যারা আন্দোলনের ডাক দিয়ে কোনো অবস্থাতেই রাজপথ থেকে পালাবেন না এবং অতীতের ইমানি পরীক্ষায় পরীক্ষিত সব হিসাব-নিকাশের ঊর্ধ্বে উঠে তাদেরই আগামী দিনের কমিটিতে ‘ম্যাডাম’ দায়িত্ব দেবেন বলে আমরা আশা করছি। তিনি বলেন, ‘ম্যাডামের প্রত্যাশা’ অনুযায়ী আমরা বিগত আন্দোলনে তেমন ভূমিকা রাখতে পারিনি। কিন্তু অনেকেই চেষ্টা করেছি। নব্বইয়ের আন্দোলনের আরেক নেতা খায়রুল কবির খোকনের বক্তব্য, ‘ম্যাডাম’ই সব সিদ্ধান্তের মালিক। তিনি নিশ্চয়ই যোগ্যদের যথাযথ স্থানে বসাবেন এটাই আমার বিশ্বাস।