মঙ্গলবার, ২৯ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল

রিট খারিজ

নিজস্ব প্রতিবেদক

সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে অন্তর্ভুক্তির বিধান চ্যালেঞ্জ করে ২৮ বছর আগে দায়ের করা রিট আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি নাঈমা হায়দার, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক এবং বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল এ আদেশ দেন। এ রিটের পরিপ্রেক্ষিতে জারি করা রুলও খারিজ করে দিয়েছেন উচ্চ আদালত। রুলে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে অন্তর্ভুক্তির বিধান কেন অসাংবিধানিক ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। আইনজীবীরা জানিয়েছেন, এর ফলে বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামই বহাল থাকছে। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী এবং এ কে এম জগলুল হায়দার আফ্রিক। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের পক্ষে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী বিচারপতি টি এইচ খান এবং এ বি এম নুরুল ইসলাম।

রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে ইসলামের অন্তর্ভুক্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৯৮৮ সালে দেশের ১৫ জন বিশিষ্ট নাগরিক এ রিট আবেদন করেন। এই রিট আবেদনের ২৩ বছর পর ওই রুল জারি করা হয়েছিল। রুল জারির পাঁচ বছর পর গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রুলের শুনানির জন্য ২৭ মার্চ তারিখ ধার্য করা হয়। এর এক দিন পর গতকাল রুলের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। দুপুরে শুনানির শুরুতে রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা আদালতে বলেন, মাই লর্ড। রাষ্ট্রধর্মের এই মামলাটি লিস্টে এসেছে। এটা অনেক পুরনো মামলা। দুটি রুল হয়েছে। অনেক পুরনো ম্যাটার। ১৯৮৮ সালের রিট। পরে দুটি সম্পূরক আবেদনের রুল। এজন্য আমাদের কিছু সময় দরকার। এ সময় আদালত বলেন, আপনার সময় দরকার। ঠিক আছে, আপনি বসুন। আমরা আগে আবেদনকারীর আইনজীবীর বক্তব্য শুনব। পরে সিনিয়র আইনজীবী বিচারপতি টি এইচ খান, এ বি এম নুরুল ইসলামসহ কয়েকজন আইনজীবী রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম বহালের পক্ষে পক্ষভুক্ত হওয়ার আবেদন নিয়ে দাঁড়ান। এ সময় আদালত বলেন, আপনারা বসুন। এখনো শুনানি শুরুই হয়নি। আগে রিট আবেদনের আইনজীবীকে শুনব। পরে পক্ষভুক্ত হওয়ার বিষয়ে। এ সময় আদালত আবেদনকারীদের আইনজীবী সুব্রত চৌধুরীকে বলেন, আপনাকে আমরা দেখে আসতে বলেছিলাম ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’র পক্ষে এ রিট দায়ের করার এখতিয়ার ছিল কিনা। জবাবে সুব্রত চৌধুরী বলেন, সংগঠন ছাড়াও পৃথকভাবেও প্রত্যেকে রিটে বাদী হয়েছেন। আদালত বলেন, আমরা দেখছি, ওই সংগঠনটির পক্ষে রিট করা হয়েছে। জবাবে সুব্রত চৌধুরী বলেন, শুনানির সময় আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত বলব। সন্তোষজনক জবাব দেব। আদালত বলেন, ওই সংগঠনের রিট করার এখতিয়ার নেই। রিট খারিজ, রুল ডিসচার্জ। পরে আদালত থেকে বেরিয়ে সুব্রত চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, আদালত আমাদের আবেদন খারিজ করেছেন। আদালত বলেছেন, এই সংগঠনের নামে মামলা করার এখতিয়ার নেই। পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর আমরা আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা সাংবাদিকদের বলেন, এ রায়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম বহাল থাকার পাশাপাশি অন্য ধর্মের অধিকারও বহাল থাকল। রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে ইসলামের অন্তর্ভুক্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৯৮৮ সালের আগস্টে ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’র পক্ষে সাবেক প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেনসহ ১৫ জন নাগরিক এ রিট করেন। এরপর থেকেই আবেদনটি হাইকোর্টে বিচারাধীন ছিল। বিগত নবম সংসদে সংবিধান সংশোধনের উদ্দেশ্যে গঠিত বিশেষ কমিটিও রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখার পক্ষে সুপারিশ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে অন্যতম রিটকারী সাংবাদিক ফয়েজ আহ্মদ রিটটি শুনানির জন্য হাইকোর্টে ২০১১ সালের জুনে একটি সম্পূরক আবেদন করেন। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী এবং বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই বছরের ৮ জুন রুল জারি করেন। রুলে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে অন্তর্ভুক্তির বিধান কেন অসাংবিধানিক ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম বহাল থাকার পরে রিট আবেদনকারী পক্ষ পঞ্চদশ সংশোধনীতে থাকা ওই বিধান চ্যালেঞ্জ করে সম্পূরক আবেদন করে। শুনানি নিয়ে ২০১১ সালের ১ ডিসেম্বর বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সম্পূরক রুল দেন। পরে রুল শুনানির জন্য বৃহত্তর বেঞ্চ চেয়ে গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর রিটকারী পক্ষ প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করেন প্রধান বিচারপতি। এর ধারাবাহিকতায় বিষয়টি হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চে শুনানির জন্য আসে। রিট আবেদনকারীদের মধ্যে আরও ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, সাবেক বিচারপতি কে এম সোবহান, অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ, আইনজীবী সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফী, অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন, মেজর জেনারেল সি আর দত্ত (অব.), বদরুদ্দীন উমর, সাংবাদিক ফয়েজ আহ্মদ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ও অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তাদের মধ্যে অনেকেই মারা গেছেন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে চতুর্থ সংসদে ১৯৮৮ সালের ৫ জুন সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী অনুমোদন হয়। এর মাধ্যমে সংবিধানে অনুচ্ছেদ ২-এর পর ২ (ক) যুক্ত হয়। ২ (ক)-তে বলা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হইবে ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে’। পঞ্চদশ সংশোধনীর পর সংবিধানের ২(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন’।

আমার কোনো সম্পর্ক নেই : রিট আবেদনকারীদের অন্যতম ও জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর রাষ্ট্রধর্ম আইনসংক্রান্ত রিটের সঙ্গে তার কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছেন। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি এ রিট আবেদনের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা নাকচ করে বলেন, ১৯৮৮ সালে এরশাদ সরকার কর্তৃক রাষ্ট্রধর্ম আইন করার সময় যে প্রতিরোধ কমিটি হয়েছিল আমি এর প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলাম। কমিটির পক্ষ থেকে রাষ্ট্রধর্ম বিধান বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়েছিল। আমি একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি। রাজনৈতিকভাবে আমরা সে সময় আন্দোলন করেছিলাম এবং আন্দোলনের অংশ হিসেবে মামলা করা হয়েছিল। কিন্তু তখন যে পরিস্থিতিতে মামলা করা হয়েছিল সে পরিস্থিতি এখন আর নেই।

রাষ্ট্রধর্ম বহালে প্রধান বিচারপতিকে স্মারকলিপি : এদিকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে বহাল রাখার দাবিতে গতকাল সকালে প্রধান বিচারপতিকে স্মারকলিপি দিয়েছে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা মহানগর কমিটি। সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের মাধ্যমে কমিটির যুগ্ম সদস্যসচিব ফজলুর রহমান কাসেমীর নেতৃত্বে এ স্মারকলিপি দেওয়া হয়।

জামায়াতের নামমাত্র হরতাল : রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিলের ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে গতকাল জামায়াতে ইসলামীর ডাকা নামমাত্র হরতাল পালিত হয়েছে। দলটি হরতাল ডাকলেও এর সমর্থনে মাঠে কোনো নেতা-কর্মীকে দেখা যায়নি।

ইসলামী দলগুলোর সন্তুষ্টি : রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে ইসলামী আন্দোলনের আমির চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেন, ইসলামী জনতার সেন্টিমেন্ট বিজয়ী হয়েছে। এছাড়া বিবৃতি দিয়েছেন, খেলাফতে ইসলামী বাংলাদেশের আমির মাওলানা আবুল হাসানাত আমিনী, আওয়ামী ওলামা লীগসহ সমমনা ইসলামী ১৩টি সংগঠন, ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির আমির মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাসসহ বিভিন্ন ইসলামি দলের নেতারা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর