বুধবার, ৩০ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

মৃত্যুপুরী লিবিয়ায় যাচ্ছে কর্মী

জুলকার নাইন

মৃত্যুপুরী লিবিয়ায় যাচ্ছে কর্মী

গৃহযুদ্ধের কারণে প্রায় মৃত্যুপুরী হয়ে ওঠা লিবিয়ায় কর্মী পাঠানোর পাঁয়তারা করছেন একশ্রেণির জনশক্তি রপ্তানিকারক। যখন-তখন কামানের গোলাবর্ষণ হতে থাকা লিবিয়ার পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক বলে দাবি করে বাংলাদেশে বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছেন কিছু ব্যবসায়ী। আবার লিবিয়ায় গিয়ে সেখান থেকে ইউরোপ যাওয়ার সুযোগ রয়েছে বলেও দেখানো হচ্ছে প্রলোভন। কতিপয় ব্যবসায়ীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশে থাকা লিবিয়া দূতাবাস-সংশ্লিষ্ট একটি চক্র। তাদের মাধ্যমে লিবিয়ার ১৭১ কোম্পানি থেকে প্রায় ৫২ হাজার ডিমান্ড নোট ঢাকায় এসেছে। বিপুলসংখ্যক পাসপোর্টে ভিসাও বসেছে। যে কোনোভাবে লাভজনক এ ব্যবসা চালু রাখতে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের পক্ষ থেকে ক্রমাগত অসত্য তথ্য পরিবেশনের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে কর্মী প্রেরণে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারেরও চেষ্টা চলছে। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের দেওয়া প্রকৃত তথ্যের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে এবং হবে। কারও কোনো ধরনের অসৎ তত্পরতায় প্রভাবিত হওয়ার সুযোগ নেই। জনশক্তি বাজার-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, শতাধিক রিক্রুটিং এজেন্সি লিবিয়ায় শ্রমিক হিসেবে পাঠানোর জন্য প্রায় ২০ হাজার কর্মীর ভিসা সম্পাদন করেছে। এ ছাড়া ঢাকাস্থ লিবিয়া দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা (লিবিয়ার তিন সরকারের একটি পক্ষের সাবেক প্রতিনিধি) পাঁচ হাজার ভিসা ইস্যু করেছেন। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে কর্মী ঠিক করে রেখেছে। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনড় অবস্থানের কারণে তাদের বিএমইটি ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে লিবিয়া দূতাবাস থেকে একাধিকবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন দফতরে দফায় দফায় চিঠি লিখেছে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রা। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কাছে দফায় দফায় চিঠি লিখেছে তিনটি রিক্রুটিং এজেন্সি। সর্বশেষ তিন বাংলাদেশি নিহত হওয়ার দিনও বায়রার পক্ষ থেকে লিবিয়ার বাজার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বলে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়া হয়।

লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের পলিটিক্যাল কাউন্সিলর মোজাম্মেল হক বলেন, ‘পুরো লিবিয়াতেই ২০১৪ সালের ১৩ জুলাইয়ের পর থেকে গৃহযুদ্ধ চলছে। আসলে লিবিয়ায় বর্তমানে তিনটি সরকার কাজ করছে। এর মধ্যেই নির্বাচনে পরাজিত সরকার ত্রিপোলি নিয়ন্ত্রণ করছে। নির্বাচনে বিজয়ী আন্তর্জাতিক সমর্থনপুষ্ট সরকার বেনগাজির পাশে তোঘলুক নামের একটি শহরে আছে। আর সবচেয়ে বেশি গৃহযুদ্ধের শিকার বেনগাজির নিয়ন্ত্রণে আছেন জেনারেল হাফসার। তবে জেনারেল হাফসারের সঙ্গে বিভিন্ন মিলিশিয়া বাহিনী যুদ্ধে লিপ্ত আছে। তাই কোনো শহরকেই ঠিক স্বাভাবিক বা স্থিতিশীল বলা যায় না।’ কাউন্সিলর মোজাম্মেল হক বলেন, ‘বিভিন্নভাবে বলা হচ্ছে লিবিয়ায় ৪০ হাজার বাংলাদেশি আছেন। আসলে তা ঠিক নয়। লিবিয়ায় এখন ২০-২৫ হাজার বাংলাদেশি আছেন। ইতালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উত্তাল ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে গত এক বছরে ৯ হাজার ৯৯৭ জন ইতালিতে পৌঁছেছেন। লিবিয়ার বিপত্সংকুল পরিস্থিতি, চরম অস্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও আর্থিক নিরাপত্তার অভাবেই তারা মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে এ পথে গিয়েছেন। লিবিয়ায় লুটতরাজ, ছিনতাই লেগেই আছে।’ তিনি বলেন, লিবিয়া থেকে ভারত-পাকিস্তানের প্রায় সবাইকেই ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশিরা যেতে চান না। কারণ তাদের অনেকেই এখানে এসেছেন ভিটেমাটি সব বিক্রি করে বা বন্ধক রেখে। এমনকি গোলার আঘাতে দুই হাত হারানো এক বাংলাদেশিকে দেশে ফেরত যাওয়ার সব ব্যবস্থা করা হলেও তিনি ফিরতে চাননি। কারণ ঋণ করে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে তিনি লিবিয়ায় এসেছেন। এখন নতুন করে আবারও সর্বস্বর বিনিময়ে লিবিয়ায় বাংলাদেশিরা এলে তারাও হয়তো বিপদ মাথায় নিয়েই থাকতে চাইবেন। দূতাবাস কর্মকর্তার মতে, লিবিয়ায় বাংলাদেশিদের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এখানকার শ্রমবাজার বাংলাদেশের পক্ষে ধরে রাখা মোটেও জটিল বিষয় হবে না।

বাংলাদেশি ওয়ালিদ হাসান লিবিয়া থেকে গতকাল টেলিফোনে বলেন, ‘আমি ত্রিপোলির মদিনা এলাকায় আছি। এখানে রবিবার থেকে প্রচণ্ড গোলাগুলি হচ্ছে। কামানের গোলার শব্দে কানে তালা লেগে গেছে। বাড়ির বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। আর বাড়িতেও কামানের গোলা পড়বে কি না এর নিশ্চয়তা নেই।’ কিশোরগঞ্জের শ্যামল বলেন, ‘লিবিয়ায় কোনো ব্যাংক খোলা না থাকায় দেশে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা নেই। আর দ্রব্যমূল্য আগের চেয়ে পাঁচ-ছয় গুণ বেড়ে যাওয়ায় কর্মজীবীদের পক্ষে কিনে খাওয়া প্রায় অসম্ভব।’ অন্যদিকে ২৫ মার্চ বেনগাজি শহরে রাতে গোলাগুলির সময় বাংলাদেশি আবদুর রহিম, হুমায়ুন কবির ও মোহাম্মদ হাসান গোয়ারশা এলাকা থেকে অন্যত্র নিরাপদ স্থানে যাওয়ার চেষ্টা করলে একটি মিলিটারি ক্যাম্পের সদস্যরা তাদের থামতে বলেছিলেন। কিন্তু ভয়ে ওই বাংলাদেশিরা দৌড় দেন। এরপর নির্বিচারে গুলি চালানো হয় তাদের ওপর। তিন বাংলাদেশিসহ চার বিদেশির দেহ ঘটনাস্থলেই ঝাঁঝরা হয়ে যায়। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, নিজ নিজ নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের স্বার্থে এবং যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে লিবিয়ার সব প্রবাসী বাংলাদেশিকে রাস্তাঘাটে চলাফেরা সীমিত করে এবং রাতে বাইরে বের না হয়ে যথাসম্ভব সাবধানতা অবলম্বন ও সতর্কভাবে চলাফেরার জন্য দূতাবাসের পক্ষ থেকে অনুরোধ রইল। এ ছাড়া যেসব প্রবাসী বেনগাজিসহ যুদ্ধরত অন্যান্য এলাকায় রয়েছেন, দূতাবাসের হটলাইন নম্বরে তাদের যোগাযোগ করে নিজ অবস্থান ও প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে জানাতে অনুরোধ জানানো হলো।

শুধু তা-ই নয়, সম্প্রতি লিবিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল শহীদুল হক বাংলাদেশিদের চার অসুবিধার কথা তুলে ধরে সরকারের কাছে প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, ২০১১ সাল থেকে দেশটিতে যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান থাকায় বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারি প্রকল্পগুলোতেও স্থিতাবস্থা চলছে। সেখানে কাজের সুযোগ কমে এসেছে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশি যারা আছেন, তারা অল্পসংখ্যক কোম্পানিতে কাজে আছেন। কিন্তু তাদের ছয় মাস থেকে এক বছরের বেতন নেই। তৃতীয়ত, শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। অনেকে অস্ত্রধারী ডাকাতদের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন। চতুর্থত, এত অসুবিধার পরও যারা কাজ করছেন এবং কিছু আয়-রোজগার করছেন, তারা দেশে টাকা পাঠাতে পারছেন না। এমন পরিস্থিতিতেও লিবিয়াগামী কর্মীদের ছাড়পত্র প্রদানের বিষয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিস (বায়রা) প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপি বরাবর চিঠিতে লিবিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশিদের সম্ভাবনা এবং কয়েক হাজার কর্মীর ভিসার ছাড়পত্রের জন্য আবেদন জানাচ্ছে। বায়রার চিঠিতে বলা হয়, ‘লিবিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের বিষয়ে যে চাহিদাপত্র ও ক্ষমতাপত্র দিয়েছে, সেটি স্বনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় যাচাই করেছে ঢাকাস্থ লিবিয়া দূতাবাস। তারা এর সত্যতা পেয়ে চার-পাঁচ হাজার ভিসা ইস্যু করেছে। ভিসা পাওয়ার পরও দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজমান; দুই থেকে আড়াই মাস ধরে কোনো কর্মী প্রেরণের চেষ্টা করা হয়নি। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। যেসব প্রতিষ্ঠান কর্মী নেওয়ার চাহিদাপত্র দিয়েছিল তারা রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে কর্মী প্রেরণের জন্য চাপ দিচ্ছে।’ ভিসা হওয়ার পরও কর্মী পাঠাতে না পারায় লিবীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজে বিঘ্ন ঘটছে জানিয়ে বায়রার আবেদনে বলা হয়, ‘যেসব কর্মী ভিসা পেয়েছেন তাদের মেয়াদ স্বল্প সময়ের মধ্যে উত্তীর্ণ হয়ে যাবে। এতে প্রতিটি কর্মী আর্থিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ফলে তারা হতাশায় নিমজ্জিত হবেন এবং দেশ বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হবে।’ বায়রা সভাপতি আবুল বাশার গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘লিবিয়ায় সম্প্রতি একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এটিকে ভিত্তি করে পুরো শ্রমবাজার নষ্ট করা উচিত হবে না। প্রয়োজনে কিছু মানুষ পাঠিয়ে টেস্ট করে দেখা যেতে পারে। যাদের পাসপোর্টে ভিসা লেগে গেছে তাদের পাঠিয়ে দেখা যেতে পারে পরিস্থিতি কী হয়। আর কোনো অসুবিধা হলে আমরা তো ফেরত আনবই। এ ছাড়া আমরা প্রত্যেকের জন্য বিমার ব্যবস্থাও করতে রাজি। কোনো ক্ষতি হলে তাদের পরিবার প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ পাবে।’ বায়রা সভাপতি বলেন, ‘যখন মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে, তখন লিবিয়ার বাজার রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাই। এর মাধ্যমে দেশের মানুষের বেকারত্ব দূর হবে। আসবে বৈদেশিক মুদ্রা।’

সর্বশেষ খবর