শনিবার, ২ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা
লেখকের অন্য চোখ

নুন ছাড়া আলুনি লাগে

সমরেশ মজুমদার

নুন ছাড়া আলুনি লাগে

কিছু কিছু লেখক ছিলেন এবং এখনো আছেন যারা বছরের পর বছর লিখে চলেছেন, প্রায় প্রতি মাসেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাদের গল্প ছাপা হয়, কোনো কোনো নববর্ষ সংখ্যায় উপন্যাসও। এরা যখন লিখতে শুরু করেছিলেন, সেই আটাশ-তিরিশ বছর বয়সে, তখন এদের তরুণ লেখক বলা হতো। নাট্যাচার্য, নটসূর্য, যাত্রাসম্রাট ইত্যাদি উপাধির মতো ‘তরুণ লেখক’ও যে উপাধি হয়ে উঠতে পারে তা জানা ছিল না। এরাও জানতেন না। পঞ্চাশ পেরিয়ে গিয়েও যখন বিজ্ঞাপন বা আলোচনায় এদের নামের আগে তরুণ লেখক শব্দ দুটি এক করে ব্যবহূত হয় তখন তাদের মন পছন্দ করে না কিন্তু আপত্তিটা মুখ দিয়ে বের হয় না। সবাই জানি, তরুণ লেখক তাকেই বলা হয় যার মধ্যে পাঠক-সম্পাদক-বড় লেখক হওয়ার সম্ভাবনা যেমন দেখেন, তেমন তিনি বয়সেও নবীন। আমাদের শংকরদা, মণিশংকর মুখোপাধ্যায় অল্প বয়সে কত অজানারে লিখে খ্যাতি পেয়েছিলেন। তারপর তাকে পেছনে তাকাতে হয়নি। প্রফুল্লদা, প্রফুল্ল রায় মাত্র উনিশ-কুড়ি বছর বয়সে অনবদ্য উপন্যাস ‘পূর্বপার্বতী’ লিখেছিলেন। দেখা গেল তাদের লেখা পড়ার জন্য পাঠক তৈরি হয়ে গেছে। তখন আর তাদের তরুণ লেখক বলা হতো না। প্রতিষ্ঠিত লেখকদের শ্রেণিতে পৌঁছে দেওয়া হলো যৌবনের শুরুতেই। আমরা যখন লিখতে শুরু করেছিলাম এ রকম বয়স্ক তরুণ লেখক অনেকেই ছিলেন বেশ ভালো লিখতেন। তারা বহু বছর ধরে পত্রিকার সম্পাদককে সাহায্য করতেন পাতা ভরানোর কাজে। বিমল করকে ঘিরে লেখকদের যে আড্ডা বসত তাতে নিয়মিত হাজিরা দিতেন তারা। দেশ-আনন্দবাজারে প্রচুর লিখেছেন কিন্তু পাঠকরা তাদের কোনো গল্পের নাম মনে রাখতে পারতেন না। মনে রাখতে হবে, তাদের কেউ তথাকথিত আঁতেল ছিলেন না, সহজ স্বাভাবিক মানুষের মতো আন্তরিক ছিলেন। আমি অবাক হতাম। কেন তাদের লেখা পাঠক গ্রহণ করছেন না! পাঠক কোন লেখকের লেখা পড়তে চান তার খবর সবচেয়ে আগে রাখেন প্রকাশকরা। বই প্রকাশ করা প্রকাশকদের ব্যবসা। ব্যবসা করে কোন মূর্খ ঘরের টাকা জলে ফেলতে চাইবেন। প্রকাশক চাইবেন লেখকের বই ছেপে লাভ করতে। অন্তত আট সাড়ে আটশ বই বিক্রি হয়ে গেলে খরচের টাকা ফেরত আসে। সেটুকু যদি এক বছরে বিক্রি হয় তাহলে পরের বছরে যা পাঠক কিনবে তাই লাভ হিসেবে ঘরে আসবে। অতএব প্রকাশক সেই লেখককে খোঁজেন যার বই অন্তত আট সাড়ে আটশ বিক্রি হবেই। যাযাবর তো সবাই নন যে প্রথম বই ছাপামাত্র হৈহৈ করে বিক্রি হবে। তাদের খুঁজে পাওয়া মানে প্রকাশক গুপ্তধন পেলেন, কিন্তু তাকে ব্যবসা চালাতে হবে। প্রতিষ্ঠিত লেখক, যাদের বই বছরে কয়েক হাজার বিক্রি হয় তাদের হিমশিম খাওয়ার মতো অবস্থা। বয়স বাড়ছে, একের পর এক চলেও যাচ্ছেন। তাই নতুন লেখক না দাঁড়ালে সমস্যায় পড়বেন প্রকাশকরাই। অতএব সারা বছরই তারা খোঁজ করেন তরুণ লেখকরা কে কী রকম লিখছেন। আমি প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বললাম। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনারা সুযোগ দিচ্ছেন না কেন?’ ‘কী করে দেব বলুন? আমাদের দোকানে বা বইমেলার স্টলে যারা বই কিনতে আসেন তাদের প্রশ্ন করি নতুন কোন লেখকের লেখা পত্রিকায় পড়তে ভালো লাগে? বেশির ভাগই মনে করতে পারেন না। কেউ কেউ অবশ্য নাম বলেন, আমরা যার নাম পাঠক বেশি করেছেন, তার সঙ্গে যোগাযোগ করি। জানতে পারি ইতিমধ্যে দুজন ছোট প্রকাশক তার গল্প বা উপন্যাস ছেপেছেন। কীরকম বিক্রি হয়েছে জিজ্ঞাসা করলে লেখক বললেন, ‘খুব ভালো, আমার পরিচিতরা অনেক বই কিনেছেন কিন্তু প্রকাশক চেপে যাচ্ছেন। বলছেন, কিছুই বিক্রি হয়নি। আপনারা বড় প্রকাশক বলে ভরসা রাখছি।’ কোন বই কীরকম বিক্রি হচ্ছে তার খবর বাইন্ডারের কাছে পাওয়া যায়। জানলাম প্রথম বাঁধাইয়ের একশ এখনো শেষ হয়নি। বলুন, কী করে আবার ওর বই ছাপি? কেন এটা হচ্ছে? বিমল কর একটা সুন্দর কথা বলেছিলেন, ‘দ্যাখ ওরা খারাপ লিখছে না, খুব চেষ্টা করছে কিন্তু লেখাগুলো দাঁড়াচ্ছে না।’ ছোটগল্প তবু ভালো কিন্তু উপন্যাসে পাঠক খুশি হচ্ছে না, কারণ রান্না যেমন নুন ছাড়া খাওয়া যায় না, আলুনি লাগে তেমনই ওদের লেখায় সেই নুনটাই নেই। অথচ তুলসী সেনগুপ্ত, নিখিলরঞ্জন সরকার, সত্যেন্দ্র আচার্য বা প্রলয় সেনরা লেখার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস ছিলেন। এদের কোনো দল ছিল না। কিন্তু এ ধরনের কিছু লেখক দল তৈরি করে নিয়েছিলেন। কফি হাউসে তাদের নিয়মিত আড্ডা হতো। নিজেদের লেখা প্রচারিত করার জন্য চমকপ্রদ ক্যাপশন আবিষ্কার করেছিলেন। মনে আছে রমাপদ চৌধুরী মশাই উদ্যোগ নিয়েছিলেন এসব লেখককে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে। প্রতি বছর বড় কাগজের শারদীয়া সংখ্যায় একজনের পর একজনের উপন্যাস ছেপে গিয়েছেন তিনি। একমাত্র সুচিত্রা ভট্টাচার্য ছাড়া আর কাউকে পাঠক গ্রহণ করেনি। একসময়, এই তিরিশ বছর আগেও বিখ্যাত সাপ্তাহিক পত্রিকায় ধারাবাহিক উপন্যাস লেখার সুযোগ কোনো তরুণ লেখক পেলে ধন্য হয়ে যেতেন। প্রথমে সাপ্তাহিক পরে পাক্ষিক সেই পত্রিকায় ধারাবাহিক উপন্যাস লেখা মানে পাঠকের মনের অন্দরমহলে চলে যাওয়ার সুযোগ। কিন্তু গত ২৪ বছর ধরে একমাত্র তিলোত্তমা মজুমদার ছাড়া আর কেউ ওই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারলেন না। এখন ওখানে কে ধারাবাহিক উপন্যাস লিখছেন তার খবরই অনেকে জানেন না, উপন্যাস পড়া তো দূরের কথা। মান নিম্নমুখী হলে আগ্রহ থাকে না। আমার সমসাময়িক এক তরুণ লেখকের লেখা বিভিন্ন কাগজে নিয়মিত ছাপা হতো। বিশ্বসাহিত্যের তাবড় লেখকের লেখা পড়ে ফেলেছে সে কথা বললে সেসব শুনে মুগ্ধ হতে হয়। তাকে নিয়ে গেলাম কলেজ স্ট্রিটের একজন বড় প্রকাশকের কাছে। বললাম, ‘এই তরুণ লেখকের উপন্যাস ছাপুন।’ আলাপ হওয়ার পরে প্রকাশক বললেন পাণ্ডুলিপি দিয়ে যেতে। কিন্তু সেই রাতে প্রকাশক আমায় ফোন করলেন, সমরেশ বাবু, আপনার সঙ্গে আমি তো কখনো খারাপ ব্যবহার করিনি। আমার ক্ষতি হোক কেন আপনি চাইছেন? আমি ওদের বন্ধু লেখকদের কয়েকটা বই ছেপেছি। কোনোটাই দুশ’র বেশি বিক্রি করতে পারিনি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর