বুধবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

সাক্ষী আসে না, মামলাও শেষ হয় না

রমনা বটমূলে বোমা হামলার ১৫ বছর

মির্জা মেহেদী তমাল

সাক্ষী আসে না, মামলাও শেষ হয় না

শিল্পীদের কণ্ঠে ভেসে আসছিল দেশের গান— ‘এ কি অপরূপ রূপে মা তোমায়/হেরিনু পল্লী জননী..., সুরের মূর্ছনায় মগ্ন হাজারো মানুষ। হঠাৎ বিস্ফোরণ! আগুনের ঝলকা! মঞ্চের সামনে বিকট শব্দের পরই কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন পরিবেশ। গান বন্ধ। মানুষের আর্তচিত্কার। ভীতসন্ত্রস্ত মানুষের ছোটাছুটি। রমনার সবুজ ঘাস তখন রক্তে লাল। ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া মানুষের শরীরের অংশ বিশেষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। কারও হাত নেই। কারও শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত  বেরোচ্ছে। কাতরাচ্ছে। বীভত্স্য দৃশ্য। শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ।

১৫ বছর আগে ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখ রমনা বটমূলে বর্ষবরণ উৎসব ছিল এমনই রক্তাক্ত। অনুষ্ঠান দেখতে এসে বোমায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে লাশ হয়েছিল ১০টি তাজা প্রাণ। স্বাধীন বাংলাদেশে যতগুলো নৃশংস, জঘন্য ও বর্বর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তার মধ্যে এটি অন্যতম।

নারকীয় এই হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলার বিচার কাজ এখনো শেষ হয়নি। হত্যা মামলাটি দীর্ঘ ১৩ বছর পর রায় হলেও তা ডেথ রেফারেন্সের শুনানির জন্য রয়েছে হাইকোর্টে। বিস্ফোরক মামলাটির সাক্ষী না আসায় বিচারকাজ থেমে আছে। দফায় দফায় সমন দিলেও সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে আসছেন না। গত দুই বছরে মাত্র দুজন সাক্ষ্য দিয়েছেন। এমন এক পরিস্থিতিতে বিচারকাজ শেষ হবে কবে, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। জানা গেছে, বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলাটি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এ বিচারাধীন। ২৪ এপ্রিল সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে। এ মামলার চার আসামি এখনো পলাতক। মামলাটির বিচারকাজ ঝুলে থাকার বিষয়ে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর সরকারি কৌঁসুলি আবু আবদুল্লাহ ভূঁইয়া বলেন, সাক্ষীদের হাজির করতে দফায় দফায় সমন দেওয়া হয়েছে। তবু সাক্ষীরা আসছেন না। তিনি বলেন, একটি মামলা নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়ায় সাক্ষীরা এ মামলায় সাক্ষ্য দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। সূত্র জানায়, ২০০১ সালে বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা ঘটনায় দায়ের হত্যা মামলার রায় হয়েছে ওই হামলার প্রায় ১৩ বছর পর ২০১৪ সালের ২৩ জুন। রায়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের (হুজি-বি) শীর্ষনেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ আটজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত। ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে শুনানির অপেক্ষায় আছে। বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০০৯ সালে এই মামলায় প্রথম অভিযোগ গঠন করার পর সাতজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। ২০১৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি একটি ধারা সংশোধন করে নতুন করে অভিযোগ গঠন করা হয়। এরপর গত দুই বছরে মাত্র দুজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ মামলায় ৮০ জন সাক্ষীর মধ্যে এ পর্যন্ত নয়জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হন। এ ঘটনায় পুলিশ রমনা থানায় মামলা করে। ২০০৬ সালের ১৯ নভেম্বর এ মামলায় মুফতি আবদুল হান্নান আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার পর ঘটনার জট খোলে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এ মামলার তদন্তে গতি সঞ্চার হয়। ২০০৮ সালের ২৯ নভেম্বর মুফতি হান্নানসহ ১৪ জনকে আসামি করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আদালতে ওই ঘটনায় দুটি অভিযোগপত্র দেয়। এর একটি হত্যা ও অপরটি বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে। এই ১৪ আসামির মধ্যে হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া আসামিরা হলেন— মুফতি হান্নান, মাওলানা আকবর হোসাইন ওরফে হেলাল উদ্দিন, আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মাওলানা তাজউদ্দিন (সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই) এবং হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম ওরফে ওস্তাদ জাহাঙ্গীর বদর। এদের মধ্যে প্রথম চারজন কারাগারে এবং শেষোক্ত চারজন পলাতক। অপর ছয় আসামিকেই হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। কারাগারে আটক এই ছয় আসামি হলেন— হাফেজ আবু তাহের, মাওলানা সাব্বির ওরফে আবদুল হান্নান, হাফেজ ইয়াহিয়া, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, মাওলানা আবদুর রউফ ও শাহাদাত উল্লা ওরফে জুয়েল।

সর্বশেষ খবর