বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা
লেখকের অন্য চোখ

মনে হতো মূর্ধন্য-ষটাকে দন্ত-স করে দিই

সমরেশ মজুমদার

মনে হতো মূর্ধন্য-ষটাকে দন্ত-স করে দিই

আমাদের বাল্যকালে ‘পরিষেবা’ শব্দটি তেমন ব্যবহার করা হতো না। অন্তত স্কুলে পড়ার সময় জলপাইগুড়ি শহরে শব্দটি চোখের সামনে আসত না। মোটামুটিভাবে বলা চলে, শব্দটি সচল হলো বামফ্রন্টের আগমনের পরে। কেন জানি না, শব্দটিকে যখন আমি প্রথম দেখেছিলাম তখন অপছন্দ করেছিলাম। এটা হয়ে থাকে। কোনো কোনো মানুষের সঙ্গে প্রথম দেখা মন ভালোভাবে নিতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রেই এসব ভাবনার বদল হয়েছে মেলামেশার পরে। কিন্তু পরিষেবার পেটকাটা মূর্ধন্য-ষ আমাকে খোঁচা দিত। ‘সেবা’কে ‘ষেবা’ বলে মানতে পারতাম না, যতই ব্যাকরণ মেনে ‘পরি’র পরে ব্যবহূত হোক। কেবলই মনে হতো মূর্ধন্য-ষটাকে দন্ত-স করে দিই। বড় বড় হোরডিং-এ শব্দটিকে দেখলে চোখ বন্ধ করতাম। চলন্তিকা বলছে, পরিষেবক রোগীর সেবা করেন। অর্থাৎ নার্স। স্ত্রীলিঙ্গে পরিষেবিকা। তাদের কাজটা হলো পরিষেবা। সেবক, সেবিকা, সেবা অন্য যে কোনো অর্থে ব্যবহূত হতে পারে। যেমন— সুস্থ শাশুড়ির সেবা করছেন নতুন পুত্রবধূ। আগে স্বামীকে চিঠি লিখে শেষ করত স্ত্রী,  ‘তোমার সেবিকা সাবিত্রী’ ইত্যাদি লিখে। পিতাকে পুত্র চিঠি লিখে শেষ করত ‘সেবক অমুক’ বলে। কিন্তু এসব স্বাভাবিক অবস্থার সময়। অসুখ-বিসুখ হলে সেবা হয়ে যাবে পরিষেবা। যিনি সেবা করছেন তিনি পরিষেবক বা পরিষেবিকা এবং খোদ সেবা হয়ে যাবে পরিষেবা, এটা অব্যবহারে অস্বস্তি আনত। আমার বন্ধু বিধান সান্যাল তখন পিজি হাসপাতালের সর্বাধিনায়ক ডাক্তার। প্রবল প্রতাপ তার। জিজ্ঞেস করলাম, হাসপাতালে পরিষেবা কীরকম উন্নত হয়েছে?

সে বলল,  প্রভূত।

শুনে আনন্দ হলো। জিজ্ঞেস করলাম,  কীরকম?

—মানুষ এখানে ওখানে থুতু ফেলে না। হাসপাতালের এলাকায় ঢুকে কেউ আর ধূমপান করে না। দেওয়াল দেখলেই জলবিয়োগ করতে দাঁড়িয়ে যায় না।

—এগুলো না হয় পাবলিক বন্ধ করেছে। কিন্তু তার সঙ্গে পরিষেবা বাড়ার কি সম্পর্ক? তোমরা কী করছ?

—আশ্চর্য! সারা হাসপাতালে বোর্ড টাঙিয়েছি,  যেখানে সেখানে থুতু ফেলবেন না, ধূমপান করবেন না, জলবিয়োগ করবেন না। সেটা পরিষেবার একটা বিশেষ অঙ্গ। তাই ওগুলো বন্ধ হয়েছে। এই পরিষেবাতে কম খরচ হয়েছে ভেবেছ?

—খরচ?

—দ্যাখো ভাই, চিকিৎসা মানেই খরচ। ডাক্তারি পড়তে যত খরচ হতো, তা অন্য স্ট্রিমে হতো না! ইদানীং দামি কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং এমবিএ পড়ার জন্য লাখ লাখ টাকা দিতে হচ্ছে। আমাদের সময়ে ওসব পড়ার অত প্রাইভেট কলেজ ছিল না যে চাইবে। এখনো তেমন তেমন মেডিকেল কলেজে গিয়ে দ্যাখো, যেন সর্ষের ফুল দেখবে। — হাসল সান্যাল।

—হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার দেখাতে হলে লাইন দিতে হতো। এখন হয়?

—বোকারা লাইন দেয়। চালাকদের কখনোই লাইন দিতে হয় না। দ্যাখো, পরিষেবা আছে, কিন্তু সেটা নিতে জানতে হয়।

—যেমন?

—ধরো তুমি একজন বিশেষ অর্থোপেডিক ডাক্তারকে তোমার হাঁটু দেখাতে চাও, যার ও ব্যাপারে প্রবল খ্যাতি আছে। তুমি হাসপাতালে না গিয়ে সোজা তার বাড়ির চেম্বারে চলে যাও। পাঁচশো দক্ষিণা দিয়ে তাকে দেখাও। অপারেশনের দরকার হলে জেনে নাও কবে কখন তিনি হাসপাতালের আউটডোর আলোকিত করবেন। সেদিন সকালে এসে টিকিট করে নিয়ে দালালকে দাও। সে ডাক্তারকে দিয়ে লিখিয়ে আনবে— এখনই ভর্তি হতে হবে। তোমাকে লাইন দিয়ে ডাক্তার-দর্শন করতে হবে না। ওটার বলে তুমি বিছানা পেয়ে গেলে। ডাক্তারকে পাঁচশো আর দালালকে শখানেক দেওয়ায় পরিষেবা পেয়ে গেলে। ভেরি চিপার। — বিধান হাসল।

—একটা অভিযোগ করছি। অপারেশনের আগে ও পরে নার্সগুলো হু হু করে ওষুধ কেনায়, যে ওষুধ সাতদিনে শেষ হবে তা পরের দিন বদলে অন্য ওষুধ আনতে বলে। সেটা এমারজেন্সির সময় বলে না কিনে বসে থাকা যায় না। একজনের স্ত্রীর সিজার হয়েছিল। শুধু দুটো তুলোর প্যাকেট পেয়েছিল। না-ব্যবহার বা কিছু-ব্যবহার করা ওষুধগুলো গেল কোথায় বলতে পার?

—তোমাদের কে বলেছিল গাদা গাদা ওষুধ কিনে দিতে? দিনে তিনটে ক্যাপসুল হলে আজ চারটে কাল চারটে দিতে পারতে। তাছাড়া পরিষেবা আছে জেনেও তোমরা তা ঠিকভাবে গ্রহণ করতে পার না।

— কীরকম?

—ওষুধ কিনে দেওয়ার আগে নার্সদের দুটো পাঁচশো টাকার নোট দিয়ে বলা উচিত ছিল, বাড়ির জন্য একটু মিষ্টি নিয়ে যাবেন। দেখতে হাজার টাকার বেশি ওষুধের বিল হতো না। তোমার সেই একজনের দু’হাজার খরচ হতো, এক হাজার বেঁচে যেত। অবশ্য একটা কথা তোমাকে মানতেই হতো, শরীর মানেই খরচ। হাজার হাজার টাকা খরচ করছ বলে তুমি দাবি করতে পার না, রোগীকে সুস্থ করে বাড়ি নিয়ে যাবে। কয়েক লাখ খরচ করে বাইপাস করালে, কিন্তু রোগী ছবি হয়ে গেল। তখন কী বলে আফসোস করবে? টাকা গেল, না রোগী গেল?

—তাহলে পরিষেবা ভালো হয়েছে বলে এই যে প্রচার?

—আলবাত ভালো হয়েছে। তোমার বাইপাস করতেই হবে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর জিজ্ঞেস করা হবে, কী রঙের ফুল তুমি পছন্দ কর? তুমি যদি বল লাল, তাহলে তোমার বিছানার পাশে ফুলদানিতে লাল গোলাপ দেওয়া হবে। তুমি কী গান ভালোবাস? সন্ধ্যা মুখার্জির গান? বেশ তো। তোমাকে ট্রলিতে চাপিয়ে ওটিতে আনামাত্রই নিচু পর্দায় সন্ধ্যা মুখার্জির গান বাজানো হবে ‘উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা’। বুক কাটার আগে যখন তোমাকে অজ্ঞান করা হচ্ছে তখন তুমি শুনবে— ‘আরও কিছুক্ষণ না হয় রহিতে কাছে’...। মন তোমার আনন্দে ভরে যাবে। এই আনন্দিত মন নিয়ে যদি তুমি ইহলোক ত্যাগ কর তাহলে তোমার আত্মীয়-স্বজন স্বীকার করতে বাধ্য হবে, হাসপাতালের পরিষেবা উন্নতমানের ছিল।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর