গত দেড় দশকে দেশের ব্যাংকিং খাতে নয়টি বড় ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারি হয়েছে। আর গত সাত বছরে ঘটা ছয়টি বড় আর্থিক কেলেঙ্কারিতে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি লোপাট করা হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে এসব আর্থিক কেলেঙ্কারিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ দেশের সাধারণ মানুষ। কিন্তু একটি কেলেঙ্কারিরও বিচার হয়নি। উল্লেখযোগ্য কারও শাস্তি হয়নি এখনো। বর্তমানে সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি ও খেলাপি ঋণ বড় সমস্যা। নিরাপত্তাহীনতা এবং বিনিয়োগের যথাযথ পরিবেশ না থাকায় সুইস ব্যাংকে বেড়েছে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থ। গতকাল রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত ‘ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। বক্তারা বলেন, বিগত বছরগুলোতে ব্যাংকিং খাতে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে, যা নিয়ে জনমনে তৈরি হয়েছে আস্থাহীনতা ও উত্কণ্ঠা। দেশের অর্থনীতির কল্যাণে এসব অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ করে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা আজ অত্যন্ত জরুরি। রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন ব্যাংকের অনুমোদন এবং পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। তারা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান দুটি কাজ হচ্ছে স্থিতিশীল মুদ্রানীতি পরিচালনা ও ব্যাংকিং খাতের ওপর তদারকি-নজরদারির ভিত্তিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু রিজার্ভের পরিমাণ বৃদ্ধি করা ছাড়া উল্লেখযোগ্য সফলতা দেখাতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ছাড়া নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি রোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। বৈঠকে অংশ নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে ক্ষমতা আছে তার কতটুকু প্রয়োগ করছে? ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য যথাযথ ও যোগ্য লোক নিয়োগ প্রদান করতে হবে। ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ অডিট নিয়মিত করা, ব্যাংকগুলো যাতে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে না পড়ে সেদিকে নজর রাখা, সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে কাকে ঋণ প্রদান করা হবে সেটি বিবেচনায় আনা, ঋণ আবেদনকারীর তথ্য সঠিকভাবে যাচাই করতে হবে। সুজনের সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ব্যাংকিং খাতে অত্যন্ত বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। এ খাতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। কী কারণে আজ এ অবস্থা তা আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। দলীয়করণ ও রাজনীতি ব্যাংকিং খাতকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তৃত্ব ও নজরদারি অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর আছে কিনা সে বিষয়েও সন্দেহ আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা যা আছে তা আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু নিয়ম-নীতিমালা আমাদের পালন করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে অন্য ব্যাংকসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আবার বেশি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না, একটা ভারসাম্য রাখতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে যে রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটেছে সেই ঝুঁকি এখনো যায়নি। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এখন আরও ভালো আধুনিক আইটি ব্যবস্থা স্থাপন করতে হবে। কিন্তু উন্নতমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করার পরও এটা যারা নিয়ন্ত্রণ করবেন, তারা যদি অসৎ বা অদক্ষ হন তাহলে আবারও একই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে।’ তিনি বলেন, এজন্য সৎ, যোগ্য ও দক্ষ মানুষকে নিয়োগ প্রদান করতে হবে। আর্থিক খাতের অনিয়মের জন্য বিচার করতে হবে। তাহলে বার বার এ রকম দুর্ঘটনা ঘটবে না। আর্থিক খাতের মতো একটি খাতে যদি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হয়, তাহলে তা ধ্বংস হতে বাধ্য। তিনি ঋণ প্রদান কার্যক্রম সম্পর্কে বলেন, সব সময় টাকাওয়ালাদের ঋণ প্রদান করা হয়। কিন্তু তা না করে নতুন নতুন উদ্যোক্তা ও মহিলাদের ঋণ প্রদান করা যেতে পারে। সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের সঞ্চালনায় সেমিনারে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, অধ্যাপক আবু আহমেদ, সুজনের নির্বাহী সদস্য আলী ইমাম মজুমদার, ড. সাজ্জাদ জহির, নুরুল হক মজুমদার, আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন প্রমুখ। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ফিনএক্সেলের চেয়ারম্যান ও অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমদ।