বুধবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

আবেদ তোমাকে সালাম জানাই

ড. মুহাম্মদ ইউনূস

আবেদ তোমাকে সালাম জানাই

আশি বছর পূর্তি উপলক্ষে আবেদকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।

বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে আবেদ গভীরভাবে একাত্ম হয়ে থাকবেন। দুর্দশাগ্রস্ত সাধারণ মানুষের মঙ্গলের জন্য একজন দেশপ্রেমিক নাগরিকের ঐকান্তিকতা তাকে কতদূর নিয়ে যেতে পারে, কত স্তর পার হয়ে তাকে বিশ্ব পরিমাপে নিয়ে যেতে পারে, আবেদ তার একটি অনবদ্য উদাহরণ। দেশের চরম সংকটকালে একজন নাগরিক কী করতে পারে? যে দরদ ও নিষ্ঠা নিয়ে এককভাবে এগিয়ে আসতে পারে। আবেদ তাই করেছেন। তিনি একজন স্বেচ্ছাসেবী হয়ে এগিয়ে এসেছেন। যেসব বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তিনি তাদের সাহায্য নিয়েছেন। তিনি তরুণদের স্বেচ্ছাসেবী হতে উৎসাহিত করেছেন। আবেদ তার উদ্যোগকে মজবুত করার জন্য একটা সংগঠন তৈরি করেছেন। তার এই সংগঠন ‘ব্র্যাক’ একদিন বিশ্বনন্দিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে এ রকম কোনো চিন্তা তার মাথায় ছিল না, কিংবা অন্য কারও মাথায়ও ছিল না। কিন্তু সংগঠনের সাফল্য তাকে সেখানে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশে তার সাফল্য এত দৃষ্টি আকর্ষণীয় হয়েছে যে, পৃথিবীর বহু দেশ তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে তাদের দেশে তার কর্মসূচি গড়ে তোলার জন্য। তিনি সে আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছেন। নানা দেশে ব্র্যাক কর্মসূচি সফলভাবে গড়ে উঠেছে। এসব দেশে গেলে দেখা যাবে বাংলাদেশিদের নেতৃত্বে সেখানে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশে-পরীক্ষিত আদলে নানা উন্নয়ন কর্মসূচি। সেসব দেশে মানুষ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে বাংলাদেশের অতিথি মানুষগুলোর প্রতি যারা এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তাদের দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে সংগঠিত করছে। যে দেশ থেকে তারা এসেছে সে দেশকে তারা শ্রদ্ধা করছে।

আবেদ শুধু ব্র্যাক সৃষ্টি করেননি, এ দেশের জন্মলগ্নে তরুণদের এমন এক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন যে, ধ্বংসযজ্ঞের যন্ত্রণায় কাতর হয়ে বসে থাকার চাইতে নতুন বাংলাদেশ গঠন করার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়াই ভালো। আবেদ তরুণ নেতৃত্বকে আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন। তারা অসম্ভব কাজে নিজেদের সমর্পণ করে দিতে এগিয়ে এসেছিল। ক্রমে ক্রমে তারা নিজেরাই নিজেদের সংগঠন তৈরি করে কাজে লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম অধ্যায়ে যত বড় বড় স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে তার বেশির ভাগেরই জন্ম হয়েছে আবেদের সহকর্মীদের মাধ্যমে। তাদের হাতেখড়ি হয়েছে ব্র্যাকে। ব্র্যাক শুধু অনন্য প্রতিষ্ঠান হয়ে গড়ে ওঠেনি, তা অন্যদের কাছে অনুকরণীয়ও হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন জায়গায় তরুণরা সমাজসেবায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজ নিজ স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান গড়ে নিয়েছে দেশের আনাচে-কানাচে। দেশে-বিদেশে প্রায়ই একটা প্রশ্ন ওঠে, বাংলাদেশ সামাজিক উন্নয়নে আশপাশের অন্যান্য দেশের চাইতে এগিয়ে গেল কীভাবে? আমি ব্যাখ্যা দিই যে, এ দেশের তরুণরা সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজ নিজ সংগঠন তৈরি করে এগিয়ে এসেছে বলে এটা সম্ভব হয়েছে। আর এই উদ্বুদ্ধ হওয়ার পেছনে আবেদের অবদান সর্বোচ্চ।

আবেদ একটা অসাধারণ কাঠামো সৃষ্টি করে দিয়েছেন সবার জন্য। কাঠামোর ভিতরে ভিতরে কাজের ছকগুলো তৈরি করে দিয়েছেন। ব্যবস্থাপনার এক অপূর্ব নিদর্শন তৈরি করে দিয়েছেন। আবেদ স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানকে ঘরকুনো না হয়ে দেশব্যাপী হওয়ার সাহস জুগিয়েছেন। আবেদের মতো এত সাহসী স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের প্রধান দুনিয়ায় আছেন বলে আমার জানা নেই। যে কোনো কঠিন কাজ নিয়ে তা দ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে তাকে কোনো দিন সংকোচ করতে দেখিনি। যে কোনো কাজ, বিশেষ করে যেখানে অসংখ্য নতুন অনভিজ্ঞ তরুণের ওপর নির্ভর করে কাজ করতে হয়, তা দ্রুত দেশব্যাপী দক্ষতার সঙ্গে স্থাপন করার ঝুঁকি এত বেশি যে, এটা ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা শতভাগের কাছাকাছি। কাজকর্ম দেখে মনে হয় আবেদের কাছে এটা নস্যি। একটার পর একটা কাজ তিনি দেশব্যাপী শুধু ছড়িয়ে দিয়েছেন তা নয়, সফলভাবে ছড়িয়ে দিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।

সামরিক বাহিনীতে স্মরণীয় যুদ্ধের স্ট্র্যাটেজি এবং প্রকৃত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া যেভাবে ভবিষ্যৎ যোদ্ধাদের জন্য লিপিবদ্ধ করা হয়, আশা করি আবেদের প্রতিটি ‘অভিযানে’র বর্ণনা ভবিষ্যৎ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালকদের জন্য, তিনি সরকারি পরিচালক হোন বা বেসরকারি পরিচালকই হোন, লিপিবদ্ধ করে রাখা হবে। আবেদের আরেকটি দিক আমাকে অবাক করে, কত সহজে তিনি যে কোনো ধরনের উন্নয়নকর্মে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আবেদের কর্মযজ্ঞের বৈচিত্র্য দেখে যে কোনো লোকের মনে হওয়া স্বাভাবিক যে তিনি কারও উন্নয়ন প্রস্তাবে বা চিন্তায় কখনো ‘না’ করেননি। এত বিভিন্নধর্মী কর্মকাণ্ডে তার বিশাল কর্মীবাহিনীকে প্রাতিষ্ঠানিক সংঘর্ষ পরিহার করে তিনি কীভাবে পরিচালনা করে গেছেন তাও একটা গবেষণার বিষয়। অন্য কেউ হলে বিশাল কর্মীবাহিনীর সমন্বয় করতে গিয়েই তিনি হাল ছেড়ে দিতেন কিংবা প্রতিষ্ঠানকে দুর্বলতার দিকে নিয়ে যেতেন। সামাজিক উন্নয়ন ব্যবস্থাপনায় আবেদ নিঃসন্দেহে ‘বিশ্বগুরু’। আমরা জাতি হিসেবে সৌভাগ্যবান যে, তিনি এ দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। এমন সময়ে জন্মগ্রহণ করেছেন যখন তার মতো প্রতিভার প্রয়োজন ছিল সবচাইতে বেশি। তার এই বিশেষ জন্মদিনে, তার সীমাহীন অবদানের জন্য কৃতজ্ঞ এবং তার গৌরবে গৌরবান্বিত, এ দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই মিলেই একযোগে তাকে সালাম জানাচ্ছি এবং মনেপ্রাণে দোয়া করছি তিনি যেন আরও বহু বছর ধরে তার প্রতিভার স্বাক্ষর এ পৃথিবীতে রেখে যেতে পারেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস : প্রতিষ্ঠাতা, গ্রামীণ ব্যাংক এবং নোবেল শান্তি পুরস্কারবিজয়ী

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর