বৃহস্পতিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা
লেখকের অন্য চোখ

ভূত দুই রকমের

সমরেশ মজুমদার

ভূত দুই রকমের

মনে হচ্ছিল, এই তো সেদিন শেখর এসেছিল কাগজের প্রথম সংখ্যার জন্য লেখা চাইতে। একটা পত্রিকা, পত্রপাঠের মতো পত্রিকা প্রকাশ করতে যে খরচ হয় তার অর্ধেকও বিক্রি বা বিজ্ঞাপন থেকে ফেরত পায়নি শেখর। সে যদি কাগজটা না করে টাকাটা মান্থলি ইনস্টলমেন্টে দিত তাহলে কলকাতার খুব ভালো জায়গায় একটা ফ্ল্যাট পেয়ে যেত। নিজের একটা সুন্দর ফ্ল্যাট হোক তা কে না চায়! ওর স্ত্রী, কন্যা খুশি হতো নিশ্চয়। কিন্তু পত্রিকার ভূত একবার মাথায় চড়লে কোনো ওঝা তাকে নামাতে পারে না। এই ভূত দুই রকমের। ব্রহ্মদৈত্য ভূত আর মামদো ভূত। মামদো ভূত ঘাড়ে চাপলে সর্বস্বান্ত না করে যাবে না। এমন হতচ্ছাড়া শয়তান ওটা। ব্রহ্মদৈত্য ভদ্র ভূত। ব্রাহ্মণত্ব মরেও হারান না। বেলগাছ ছাড়া কোথাও বাস করেন না এরা। যেহেতু কলকাতা শহরে বেলগাছ হু হু করে কমে গিয়েছে, তাই এই শহরে তারা থাকতে পারছেন না। সম্প্রতি আমার এক বন্ধু পাকিস্তানে গিয়ে বেলগাছের জঙ্গল দেখে এসেছেন। পাকিস্তান সরকার সেই জঙ্গলকে সংরক্ষিত অরণ্য বলে ঘোষণা করেছে। আমি জানি না এদেশীয় ব্রহ্মদত্যিরা সেই অরণ্যে এখন অবস্থান করছেন কি না। কিন্তু এই ব্রহ্মদত্যি কাগজ-করিয়েদের চমৎকার সাহায্য করে। ষাট দশকে একজন ভদ্রলোক বেশ মোটাসোটা লিটল ম্যাগাজিন বের করতেন। তার অফিস ছিল কলেজ স্ট্রিটের কফিহাউস। সকাল ১০টায় দোতলার কোণের টেবিলে এসে বসতেন, লেখা এবং তার প্রুফ নিয়ে। সম্পাদনা করতেন। প্রুফ দেখতেন। মাঝে দুপুরবেলায় ঘণ্টা তিনেক তাকে দেখা যেত না। আবার বিকাল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত তার অফিস চলত। তার টেবিলে তখন কবি, প্রাবন্ধিকদের ভিড়। সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে সম্পাদক হিসেবে একজন কবি কাম চলচ্চিত্র নায়কের নাম ছাপা হতো। এই নায়ককে মাঝে মাঝেই ওই টেবিলে দেখা যেত। রবিবার সকালে তো অবশ্যই থাকতেন। কাগজটির প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন সত্যজিৎ রায়। যখন কাগজ প্রকাশিত হতো তখন বিদগ্ধজনরা তা না কিনলে সমাজে মুখ দেখাতে পারতেন না। ৭ দিন পরে কোনো স্টলে আর কাগজটি অবিক্রীত থাকত না। কাগজ হাতে নিয়ে আমরা গুনে দেখতাম, কত পাতা বিজ্ঞাপন পেয়েছেন ওরা। দেখে চোখ কপালে উঠত। নামিনামি কোম্পানির বিজ্ঞাপন ঠাসা থাকত কাগজটিতে। নিন্দুকেরা বলত, ওই একটি সংখ্যায় যত বিজ্ঞাপন পাওয়া গিয়েছে তার টাকায় একটা বছর দিব্যি সংসার চালানো যায়। লিটল ম্যাগাজিন করেও যে সাফল্য পাওয়া যায় তা আগে কেউ ভাবতে পারতেন না। এটা সম্ভব হয়েছে মামদো ভূতের বদলে ব্রহ্মদত্যির নজর পড়েছিল বলে। শেখরের সেই কপাল নেই। শুধু মামদো নয়, মেছো, স্কন্দকাটা ইত্যাদি যাবতীয় ভূতবাহিনী এবং শাঁকচুন্নিরা তার ঘাড়টির দখল নেওয়ার জন্য নিজেদের মধ্যে মারপিট করে গেছে। তবে এক্ষেত্রে শেখরের স্ত্রী যদি বিরূপ হতেন তাহলে পত্রপাঠের আয়ু আগেই শেষ হয়ে যেত। কোন স্ত্রী চাইবেন স্বামী ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান? এক্ষেত্রে শুধু ঘরের খেয়ে নয়, ঘরকে অর্ধেক খাবার দিয়ে হাসির পত্রিকা বের করলে কোনো স্ত্রীর মুখে কি হাসি ফুটবে? কিন্তু শেখর অত্যন্ত কূটকৌশলে ভদ্রমহিলার রক্তে নেশাটা এমনভাবে ইনজেক্ট করে দিল যে, তিনিও নৌকায় পাল তুলে দিলেন। আবেগের হাওয়া লাগল সেই পালে। তখন ঘর, ভবিষ্যৎ মিছে সব, মিছে এ সংসারের কলরব। অতএব, প্রতি মাসে পত্রপাঠ বের করতেই হবে। দশ বছরের ভূতের চাপে যখন শেখরের মেরুদণ্ড প্রায় বেঁকে গেছে তখন সে কয়েকজন শুভানুধ্যায়ীকে এক সন্ধ্যায় নেমন্তন্ন করল। কানাঘুষোয় জানতে পারলেন ওটা পত্রপাঠের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য ডাকা হয়েছে। অনেক হয়েছে, এবার বিহঙ্গ বন্ধ করবে পাখা। ঘরভর্তি লোকজন। শেখর তার লোকসানের ফিরিস্তি দিল। সবার মুখ থমথমে। হঠাৎ একটি কণ্ঠ কথা বলল, ... আরে যদি বন্ধ করে দেবে তাহলে আমাদের ডাকলে কেন?

মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম প্রবীণ চিকিৎসক ডক্টর বারীন রায় প্রশ্নটা করলেন। তাকে সমর্থন করলেন আর একজন প্রবীণ চিকিৎসক, ডক্টর ধ্রবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়। ইনি কম কথা বলেন, তাই তিনবার মাথা ওপর-নিচ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের আবহাওয়া পাল্টে গেল। বরাবর লক্ষ্য করেছি, আবেগ খুব সংক্রামক। তারপর যা হওয়ার ছিল না তা হলো। এই দুই দাদা ভূত তাড়াতে রাজি নন। কিন্তু তাদের বাসনা, ভূতগুলোকে কাজে লাগানো যাক। ওই মামদো, মেছো, স্কন্দকাটাদের খাটিয়ে কাগজটাকে চাঙ্গা করার প্রস্তাব দিলেন ওরা। বুঝলাম, রোগ সারাতে ওদের যে নামযশ আছে তা কলকাতায় অনেকেই জানেন, কিন্তু ভূতের ঘাড় ধরে তাকে দিয়ে কাজ করাতে এরা যে খুব পারদর্শী তা আমি জানতাম না। এই ভূতগুলোকে দিয়ে বিজ্ঞাপন জোগাড় করে আনতে হবে। ওই যে কথা আছে— ছেলে রেস খেলে, খেলে আর হারে। টাকা পায় কোত্থেকে? কেন? ভূতে জোগায়। তাই ভূত যদি খারাপ কাজের জন্য টাকা জোগাতে পারে, তাহলে ভালো কাজের জন্য পারবে না কেন? এ কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রবীণ অভিনেতা শ্রীযুক্ত বাবু চিন্ময় রায়ও শপথ নিলেন, তিনি ভূত পাঠিয়ে বিজ্ঞাপন জোগাড় করে দেবেন। ধীরে ধীরে অন্ধকার পাতলা হয়ে আলো দেখা দিল। আমি জানি না, কোনো শ্রাদ্ধানুষ্ঠান পাল্টে গিয়ে কখনো অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠান হয়েছিল কি না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর