শুক্রবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

নেপথ্যে ওরা কারা

মির্জা মেহেদী তমাল ও জুলকার নাইন

নেপথ্যে ওরা কারা

মতপার্থক্য বা মতাদর্শের দ্বন্দ্বের কারণে মাত্র সাড়ে তিন বছরে খুন হয়েছেন ৩৪ জন। হামলা হয়েছে ৩৯ বার। কিন্তু এসব অপরাধের বেশির ভাগেরই কোনো কূলকিনারা হচ্ছে না। নির্দেশদাতারা থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। মাঠের খুনিরাও রহস্যজনকভাবে হয়ে যাচ্ছেন হাওয়া। ফলে অজানা থেকে যাচ্ছে এসব খুনের নেপথ্যে আসলে কারা। হামলা ও কুপিয়ে খুনের ঘটনাগুলোর পরপরই মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের নামে দ্বায় স্বীকারের টুইটার বার্তার কথা দাবি করা হলেও এগুলোর কোনো সত্যতা খুঁজে পায়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের মতে, আইএস ও আল-কায়েদার নামে বাংলাদেশের জঙ্গিরা হামলা করছে। এর মধ্যে আইএসের নাম ব্যবহার করছে জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ বা জেএমবি আর আল-কায়েদার নাম ব্যবহার করছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার-আল-ইসলাম। কিন্তু এসব প্রকাশ্য হামলার নির্দেশদাতা জঙ্গিগোষ্ঠী বা গ্রুপের নেপথ্যে থাকা শীর্ষস্থানীয় কাউকে গ্রেফতার করে এখনো সামনে আনতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো।

যদিও গত কয়েক দিনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইজিপি শহীদুল হক ও ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া ভিন্ন ভিন্নভাবে জঙ্গিদের হামলা ও খুনের সব ঘটনার তদন্তে অগ্রগতির দাবি করেছেন। ডিএমপি কমিশনার বলেছেন, ‘ব্লগার-প্রকাশক হত্যায় সারা দেশে এ পর্যন্ত ২১টি মামলা হয়েছে। তার মধ্যে ১৬টি মামলার “ডিটেকশন” হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরে মোট ১১টি মামলা হয়েছে। ওই ঘটনাগুলো জঙ্গি গ্রুপ করেছে বলে ধারণা। এ মামলাগুলোর পাঁচটির চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যা মামলার রায় হয়েছে। সেখানে আটজনকে বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড দেওয়া হয়েছে এবং দুজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে, কতগুলো মামলার এখনো তদন্ত চলছে। অভিজিৎ ও দীপন হত্যায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আছে। কারা খুন করেছে সেই নাম-ঠিকানাও পেয়েছি। কেউ গ্রেফতার হয়েছে, কিন্তু অনেককে গ্রেফতার করতে পারিনি। এরই মধ্যে দু-এক জন বাংলাদেশ ছেড়ে বাইরে চলেও গেছে। এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি।’ ঘটনা পরিক্রমা অনুসারে, যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন তুঙ্গে ওঠার পরই মতাদর্শের খুনের সংখ্যা তীব্রতা পায়। ব্লগারদের নাস্তিক আখ্যা দিয়ে শাহবাগের আন্দোলন চলাকালেই শুরু হয় চাপাতির কোপে হত্যা। ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পল্লবীর বাসার কাছে রাস্তায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে। এর তিন সপ্তাহের মাথায় ২ মার্চ সিলেটে কুপিয়ে হত্যা করা হয় গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী জগৎ জ্যোতি তালুকদারকে। ৯ এপ্রিল বুয়েটের নজরুল ইসলাম হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরিফ রায়হান দীপকে কুপিয়ে জখম করা হয়। ৮৩ দিন পর ২ জুলাই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান দীপ। এরপর একই বছরের ২১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় গোপীবাগে গলা কেটে হত্যা করা হয় কথিত পীর লুত্ফর রহমানসহ ছয়জনকে। পরের বছর ২০১৪ সালের ২৬ জুন ঢাকায় কুপিয়ে আহত করা হয় রাকিব মামুনকে। কয়েক দিন পর ১ আগস্ট সাভারে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার আশরাফুল আলমকে। ২৭ আগস্ট রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের বাসায় গলা কেটে হত্যা করা হয় টেলিভিশনে ইসলামী অনুষ্ঠানের উপস্থাপক নূরুল ইসলাম ফারুকীকে। ১৫ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক শফিউল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পরের বছর ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চাপাতির কোপে মারা যান মুক্তমনা লেখক অভিজিৎ রায়। গুরুতর আহত হন তার স্ত্রী বন্যা। পরের মাসে ৩০ এপ্রিল ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় নিজের বাসা থেকে বের হওয়ার পর রাস্তায় খুন হন অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান বাবু। ১২ মে সিলেটে বাসা থেকে বেরিয়ে অফিসে যাওয়ার পথে একই ধরনের হামলায় খুন হন আরেক মুক্তমনা ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ। তিনি গণজাগরণ মঞ্চেও যুক্ত ছিলেন। একই বছর ৭ আগস্ট দিনদুপুরে ঢাকার পূর্ব গোড়ানের এক বাসার পঞ্চম তলার কক্ষে ঢুকে হত্যা করা হয় গণজাগরণ মঞ্চের আরেক কর্মী নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়কে। ৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে কথিত এক ফকিরের আস্তানায় ঢুকে ফকিরসহ দুজনকে গলা কেটে হত্যা করে বোমা ফাটিয়ে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এরপর মতাদর্শের পার্থক্যে থাকা ব্যক্তিদের পাশাপাশি টার্গেটে পড়ে বিদেশি নাগরিক, ভিন্নধর্মাবলম্বী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। চাপাতির পাশাপাশি গুলি, বোমার ব্যবহার করে হামলা শুরু হয় তীব্র মাত্রায়। এর অংশ হিসেবে ২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার কূটনৈতিকপাড়া গুলশানে তাবেলা সিজার নামে এক ইতালীয়কে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। ৩ অক্টোবর রংপুরের কাউনিয়ায় মুখোশধারীদের গুলিতে নিহত হন জাপানের নাগরিক হোশি কোনিও, যিনি ওই এলাকায় একটি জমি ইজারা নিয়ে ঘাসের খামার করেছিলেন। ৫ অক্টোবর ঈশ্বরদীর ব্যাপ্টিস্ট মিশনের ‘ফেইথ বাইবেল চার্চ অব গড’-এর ফাদার লুক সরকারকে গলা কেটে হত্যার চেষ্টা করা হয়। একই দিন রাজধানীর বাড্ডায় নিজের বাড়ির খানকা শরিফে খুন হন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ খিজির খান। ২২ অক্টোবর ঢাকায় গাবতলীতে একটি তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের এক এএসআইকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়। ২৪ অক্টোবর রাজধানীর হোসনি দালানে শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির মধ্যে ফাটানো হয় গ্রেনেড। এতে দুজন নিহত হন, আহত হন শতাধিক। ৩১ অক্টোবর ঢাকায় হামলা হয় অভিজিৎ রায়ের বইয়ের দুই প্রকাশনা সংস্থার কার্যালয়ে। লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলসহ তিনজনকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়। একই দিনে একই সময়ে শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয় ফয়সল আরেফিন দীপনকে। ৪ নভেম্বর সাভারের আশুলিয়ায় তল্লাশি চৌকিতে হামলা চালিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় শিল্পপুলিশের এক কনস্টেবলকে। ৮ নভেম্বর রংপুর শহরে বাহাই সম্প্রদায়ের এক নেতাকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা চালায় মোটরসাইকেলে আসা তিন হামলাকারী। ১০ নভেম্বর রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার মধুপুর ইউনিয়নের চৈতার মোড়ে এক মাজারের খাদেমকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ১৮ নভেম্বর দিনাজপুরে পিয়েরো পারোলারি নামে এক ইতালীয় পাদ্রিকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা হয়। ২৬ নভেম্বর মাগরিবের নামাজের সময় বগুড়ার শিবগঞ্জের হরিপুরে শিয়া মসজিদে ঢুকে গুলি চালানো হলে মুয়াজ্জিন নিহত হন, আহত হন আরও চারজন। ৪ ডিসেম্বর দিনাজপুরের কাহারোলে ঐতিহ্যবাহী কান্তজিউ মন্দির প্রাঙ্গণে এক মেলায় বোমা হামলা হয়। ১০ ডিসেম্বর বগুড়ার কাহারোলে ইসকনের এক মন্দিরে ঢুকে গুলি ও বোমা হামলা চালানো হয়। একই দিনে চুয়াডাঙ্গায় খুন হন স্থানীয় বাউল উৎসবের এক আয়োজক। পরদিন তার লাশ পাওয়া যায়। ১৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর ঘাঁটি ঈশা খাঁ মসজিদে জুমার নামাজের সময় আত্মঘাতী হামলা হয়। এ ঘটনায় ছয়জন আহত হন, গ্রেফতার হন দুজন। ২৫ ডিসেম্বর রাজশাহীর বাগমারায় আহমদিয়া মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলায় একজন নিহত হন, আহত হন বেশ কয়েকজন। এরপর চলতি বছরের ৮ এপ্রিল রাতে রাজধানীর সূত্রাপুরের একরামপুর মোড়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজিমুদ্দিন সামাদকে। ২৩ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সর্বশেষ সোমবার ২৫ এপ্রিল নিজ বাসার শয়নকক্ষে খুন হন সমকামী অধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয়।

 

গোয়েন্দারা বলছেন, এ ধরনের হামলার শুরু বলা যায় ২০০৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার মধ্য দিয়ে। ওই হামলার ধরন ও কারণ এখনকার হামলাগুলোর সঙ্গে মিলে যায়। যারা হত্যার শিকার হয়েছেন, তারা ভিন্ন পেশার মানুষ হলেও হত্যাকারীরা তাদের ‘মতাদর্শ’ অনুযায়ী এদের লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্লগার রাজীব হায়দার ও ঘটনার পর জনতার হাতে খুনি ধরা পড়া ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যা মামলা ছাড়া বেশির ভাগ ঘটনায়ই তদন্ত শেষ হয়নি। ইতালি ও জাপানের নাগরিক হত্যায় বিএনপির কয়েকজন নেতা জড়িত বলে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু গত সাত মাসেও পুলিশ সে মামলায় অভিযোগপত্র দিতে পারেনি।

পুলিশসূত্রের তথ্য, দেশি জঙ্গি তৎপরতার বিষয়ে গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করছে কয়েকটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ঢাকার তিনটি স্থানে আনসারুল্লাহর আস্তানা থেকে উদ্ধার করা কাগজপত্র পর্যালোচনা ও গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেছে, সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত ও পলাতক মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক আনসারুল্লাহ বা আনসার-আল-ইসলামের সামরিক শাখার নেতৃত্বে এসেছেন। শিগগির বর্তমান মূল হোতাদের গ্রেফতার করে সামনে নিয়ে আসা সম্ভব হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর