শনিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

মাফিয়াদের চোখ বাংলাদেশে

টার্গেট ব্যাংক হ্যাক, অবৈধ কৌশলে বাংলাদেশ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া মানব পাচার, স্বর্ণ ও মাদক চোরাচালানে নিয়ন্ত্রণ

জুলকার নাইন

মাফিয়াদের চোখ বাংলাদেশে

বাংলাদেশের দিকে শ্যেন দৃষ্টি পড়েছে আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের। মানব পাচার, স্বর্ণ চোরাচালান, হেরোইন-কোকেনের মতো মাদক পাচারে মাফিয়া চক্রের সংশ্লিষ্টতা ছিল আগে থেকেই। এখন বাংলাদেশের আর্থিক খাতের দিকে দৃষ্টি এ চক্রের। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রযুক্তি-নিরাপত্তা ভাঙা বা হ্যাকিং এবং ঋণ বা এলসির আড়ালে বিভিন্ন অপকৌশলে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়াই লক্ষ্য মাফিয়া চক্রের। স্থানীয় বাংলাদেশিদের বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের বিদেশি সদস্যরাই তাদের লক্ষ্য হাসিল করতে চায়। সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকিংয়ের তদন্তে এমন ইঙ্গিতই পাচ্ছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। রিজার্ভ হ্যাকিংয়ের আগে আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রযুক্তি-সংশ্লিষ্ট ফিলিপিনো পরামর্শকের নিজ দেশে রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় গোয়েন্দারা মাফিয়া সংশ্লিষ্টতাকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন ক্যাসিনোর সঙ্গে এসব মাফিয়া চক্র সরাসরি যুক্ত বলেও ধারণা গোয়েন্দাদের। সূত্রমতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা ৪ ফেব্রুয়ারি ঘটলেও এর পরিকল্পনা করা হয়েছে প্রায় এক বছর আগে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই গত বছর মে মাসে ফিলিপাইনে খোলা হয়েছে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। কিন্তু এরই মধ্যে রিজার্ভ চুরির ঠিক আগে আগে ২৭ ডিসেম্বর ফিলিপাইনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তায় পাওয়া যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি বিভাগে দীর্ঘদিন কাজ করা ফিলিপিনো পরামর্শক এডিসনের মৃতদেহ। তার মৃত্যু এখনো রহস্যাবৃত। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডাটা ওয়্যারহাউস স্থাপন প্রকল্পে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ‘ইন্দ্রা ফিলিপাইন’-এর তিন বিদেশি কর্মীর প্রধান ছিলেন এডিসন। পরে রিজার্ভ চুরির মাত্র এক মাস আগে ৬ জানুয়ারি এডিসনের স্থানে নিয়োগ দেওয়া হয় স্টেসি লাও নামের আরেক বিদেশিকে। এরপর স্টেসি লাওই ছিলেন একমাত্র দায়িত্বশীল। ধারণা করা হচ্ছে, ডাটা ওয়্যারহাউস স্থাপনের কাজ করায় বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যপ্রযুক্তি-সংশ্লিষ্ট প্রায় সব তথ্য তাদের দখলে থাকতে পারে। ফিলিপাইনেরই আরেক ক্যাসিনো-সংশ্লিষ্ট কিম অং রিজার্ভের টাকা ক্যাসিনোতে জুয়ায় ব্যবহার করেছেন। আবার ফিলিপাইনের ব্যাংক ব্যবস্থাপকও দাবি করেছেন, তাকে সপরিবারে মৃত্যুর হুমকি দিয়ে কাজ করানো হয়েছে। সিআইডির তদন্ত-সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এখানে মাফিয়া সংশ্লিষ্টতা গুরুত্ব পাচ্ছে। ইতিমধ্যে তদন্তে ২০ বিদেশির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এতে বাংলাদেশিদের গাফিলতির বাইরে সংশ্লিষ্টতা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ফিলিপাইনে বাংলাদেশ দূতাবাসের এক কূটনীতিক বলেছেন, সুস্পষ্ট কিছু নাম ইতিমধ্যে বের হয়ে এসেছে। কিন্তু তদন্তের স্বার্থে এখন সেগুলো প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, ভূ-অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের দিকে মাফিয়া চক্রের নজর আছে আগে থেকেই। এর আগে গত বছর জুনে চট্টগ্রাম বন্দরে ভোজ্য তেলের কনটেইনারে কোকেনের চালান ধরা পড়ার পর শুল্ক বিভাগ ও পুলিশের গোয়েন্দাদের তদন্তেই আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের সম্পৃক্ততার বিষয়টি উঠে আসে। আটক করা হয় বাংলাদেশ, ব্রিটিশ ও ভারতীয় পাঁচ নাগরিককে। কোকেনের চালানটি বলিভিয়া থেকে উরুগুয়ের মন্টেভিডিও হয়ে আসে চট্টগ্রাম বন্দরে। আন্তর্জাতিক শিপিংলাইন কোম্পানির এমভি থর স্ট্রিজ নামের জাহাজে চালানটি মন্টেভিডিও থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। পরবর্তী গন্তব্য ছিল লন্ডন। বাংলাদেশ ব্যবহার হয়েছে ট্রানজিট হিসেবে। কনটেইনারে কোকেন পাচার হচ্ছে—এ খবর ব্রিটিশ গোয়েন্দারাই প্রথমে জানান বাংলাদেশের স্পেশাল ব্রাঞ্চকে। এর এক সপ্তাহের মাথায় ঢাকার আশুলিয়ায় এক কেজি পাউডার কোকেন উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে ২০১৩ সালের ১৭ জুন ঢাকায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের হাতে তিন কেজি কোকেনসহ হুয়ান পাবলোক নামে পেরুর এক নাগরিক গ্রেফতার হন। হুয়ান বাংলাদেশে কোকেন ব্যবসা চালানোর পরিকল্পনার কথা স্বীকারও করেছিলেন। একই পরিস্থিতি ছিল সোনা চোরাচালানের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ পাচার হয়ে আসা সোনা ধরা পড়ার পুলিশ, র‌্যাব ও শুল্ক গোয়েন্দাদের ব্যাপক অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ভারত, পাকিস্তান ও দুবাইভিত্তিক আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের ৩৭ সদস্য বাংলাদেশকে সোনা পাচারের ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। বাংলাদেশের চোরাকারবারীদের সহযোগিতায় মাফিয়ারা দুবাই,  মালয়েশিয়া ও সৌদি আরব থেকে স্বর্ণ ঢাকা ও চট্টগ্রামে নিয়ে এসে সড়কপথে ভারতে পাচার করছিল। তবে গোয়েন্দা-তথ্য বলছে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মাফিয়া চক্রের প্রভাব মানব পাচারের ক্ষেত্রে। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত এই মাফিয়া চক্রের জাল বিস্তৃত। এ ক্ষেত্রে মাফিয়ারা জল, স্থল ও আকাশপথ ব্যাবহার করছে। এর মধ্যে স্থল ও আকাশপথ ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে পেরু। এরপর বলিভিয়া হয়ে ইকুয়েডর, এল সালভাদর, পানামা, কোস্টারিকা, ইকুয়েডর, নিকারাগুয়া, গুয়াতেমালা, এরপর কলম্বিয়া, মেক্সিকো হয়ে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায়। আবার ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক হয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে হয় মানব পাচার। কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে নৌপথে কক্সবাজার হয়ে থাইল্যান্ডের জঙ্গল, এরপর মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং তারপর নৌকায় অস্ট্রেলিয়ায় পাচারকেও লাভজনক ব্যবসায় পরিণত করেছিল আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্র।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর