মঙ্গলবার, ৩ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

টার্গেট করে সিক্রেট কিলিং

সাখাওয়াত কাওসার

টার্গেট করে সিক্রেট কিলিং

টার্গেট করে সিক্রেট কিলিং নিয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। তবে নতুন করে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে হত্যা করার পর রহস্যজনকভাবে খুনিদের উধাও হয়ে যাওয়া নিয়ে। শুধু আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নয়, বিভিন্ন মহলও উদ্বিগ্ন এ ধরনের সিক্রেট কিলিং নিয়ে। তবে এসব সিক্রেট কিলিং নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল ও সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। বিশেষ কোনো গোষ্ঠী দেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে কি না তাও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা। অন্যদিকে ধর্মকে ব্যবহার করে যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন প্রচারণায় লিপ্ত, তাদের দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ দৃষ্টি রাখছে। অপরাধ-বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য কোনো একটি বিশেষ গোষ্ঠী তাদের তত্পরতা অব্যাহত রেখেছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অপরাধীদের চিহ্নিত করতে না পারার কারণে উৎকণ্ঠা আরও বাড়ছে। একই সঙ্গে ঘাতকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ার কারণে অপরাধীদের রোখা যাচ্ছে না। এসব বিষয়ে গোয়েন্দা তত্পরতা আরও বেগবান করার ব্যাপারে অভিমত দেন তারা।

নিরাপত্তা-বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মুক্তচিন্তার মানুষদের টার্গেট করেই খুন করা হচ্ছে। এর পেছনে রাজনীতি ও আঞ্চলিক জঙ্গিবাদ এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট জড়িত। এ জন্য জঙ্গিবাদের উত্পত্তিস্থল এবং মাঠপর্যায়ের মতাদর্শকে কাউন্টার করার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর তত্পরতা আরও বেগবান করা উচিত। বিশেষ করে পুলিশের গোয়েন্দা কার্যক্রম আরও জোরদার এবং তা মনিটরিংয়ের আওতায় নিয়ে আসা বেশ প্রয়োজন। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো নিয়ে পুলিশের শীর্ষ পর্যায় যেভাবে তত্পর, সেখানে মাঠপর্যায়ে সেই তত্পরতা দেখা যাচ্ছে না। এটা অনেকটা আস্থার সংকটের কারণেই সম্ভব হচ্ছে না। শর্ষের মধ্যেই ভূত রয়েছে কি না তাও মনিটরিংয়ের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, তিন বছরে উগ্রপন্থিদের ২৯ হামলার মধ্যে ২০টি হয়েছে ২০১৫ সালে। এর মধ্যে গত বছর অক্টোবরেই হামলা হয়েছে ছয়টি। ওই মাসে প্রকৌশলী খিজির খান, জাপানের নাগরিক হোশি কোনিও, ইতালির নাগরিক তাবেলা সিজার, এএসআই ইব্রাহিমকে হত্যা, খ্রিস্টান যাজক লুক সরকারকে হত্যাচেষ্টা, তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি জমায়েতে বোমা হামলা করা হয়। অবশ্য কেবল তাবেলা হত্যায় উগ্রপন্থিদের কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি বলে দাবি করেছে মামলাটি তদন্তের দায়িত্বে থাকা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গত তিন বছরে উগ্রপন্থি হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে ১১৯ জনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে অধিকাংশ আসামিকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত বছর ২ নভেম্বর রাজধানীর লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ টুটুলসহ তিনজনকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি। একই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমানের মতে, সিক্রেট কিলিং কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে বন্ধ করা সম্ভব হবে না। এটা একটা চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিকভাবে এর মোকাবিলা করতে হবে। একই সঙ্গে গোয়েন্দা তত্পরতা আরও জোরদার করার পক্ষে মত দেন তিনি।

জানা যায়, সর্বশেষ ৩০ এপ্রিল টাঙ্গাইলের গোপালপুরে দর্জি নিখিল চন্দ্র জোয়ারদার নৃশংসভাবে খুন হন। ওই ঘটনায় আটক তিনজনের কাছ থেকে উল্লেখযোগ কোনো তথ্য আদায় করতে পারেনি পুলিশ। ওই ঘটনার এর মাত্র পাঁচ দিন আগে ২৫ এপ্রিল খুন হয়েছেন ইউএসএআইডির কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয়। এর ঠিক দুই দিন আগে রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এর আগের দিন গোপালগঞ্জে কুপিয়ে মেরে ফেলা হয় পরমানন্দ সাধু নামে এক পুরোহিতকে। চলতি মাসে ঢাকায় একইভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদ। এর আগেও কয়েকজন লেখক, প্রকাশক, অনলাইন অ্যাকটিভিস্টের পাশাপাশি শিয়া, আহমদিয়া সমপ্রদায়ের লোক, বিদেশি ও যাজক-পুরোহিত আক্রান্ত হন। এসব হত্যাকাণ্ডের পর আইএস কিংবা আল-কায়েদার নামে দায় স্বীকারের বার্তা এলেও তা ভুয়া বলে উড়িয়ে দিয়ে পুলিশ বলছে, বাংলাদেশি জঙ্গিরাই এসব ঘটাচ্ছে। তবে এ ধরনের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে পারছে না তারা। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর দিকে বিশেষ নজর রাখছেন গোয়েন্দারা। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক হাদিস উদ্দীন বলেন, টার্গেট কিলিং কিছুটা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বটে, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির পুরোপুরি অবনতি ঘটেছে তা বলার সুযোগ নেই। তবে গোয়েন্দা-তথ্যে ঘাটতি আছে। সঠিক সময়ে আগাম গোয়েন্দা-তথ্য থাকলে নিশ্চয়ই ঠেকানো যেত। তাই গোয়েন্দা কার্যক্রম বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আগের হত্যাকাণ্ডগুলোর দৃষ্টান্তমূলক বিচার হলে হয়তো নতুন অপরাধের মাত্রা কমে আসত। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) নূর খান লিটন বলেন, একের পর এক এ ধরনের আক্রমণ, বিশেষ করে শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মীদের হত্যার ঘটনা মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘাতকদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না। বিচারহীনতা ও উৎকণ্ঠার সংস্কৃতি মুক্তচিন্তার মানুষদের ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতি দ্রুত এ পরিস্থিতি থেকে মুক্ত করতে হবে মানুষকে। একই সঙ্গে নিরাপত্তা-বলয় তৈরি করার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে।

সর্বশেষ খবর