বুধবার, ৪ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিএনপির শুধুই অপেক্ষা

ক্ষমতার পথ, দলের কমিটি গঠন কবে কেউ জানে না বিশৃঙ্খলা বাড়ছে, সন্দেহ অবিশ্বাস নেতায় নেতায়

মাহমুদ আজহার

বিএনপির শুধুই অপেক্ষা

২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল, এক বছরের মধ্যেই তারা ক্ষমতায় আসবেন। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর নেতা-কর্মীদের আশায় ছেদ পড়ে। এরপর শুরু হয় তাদের অপেক্ষার পালা। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি আদায় আর দল পুনর্গঠন— দুই অবস্থানেই পিছিয়ে দলটি। এতে ক্ষমতায় যাওয়ার অপেক্ষা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। কাউন্সিল পরবর্তী কমিটি নিয়েও বিএনপিতে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়েছে। নেতাদের মধ্যে সন্দেহ-অবিশ্বাসও বাড়ছে। পূর্ণাঙ্গ কমিটি কবে হবে তা দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ছাড়া কেউ জানেন না।

৫ জানুয়ারি নির্বাচনের বিরুদ্ধে নিষ্ফল আন্দোলনের পর বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে বিএনপি। খাদের কিনারে থাকা দলটিকে টেনে তুলতে গেল বছরের শেষদিকে দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু করেন বেগম খালেদা জিয়া। একই সঙ্গে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে কিছুটা চাঙ্গাভাব চলে আসে। সেই ধারাবাহিকতায় দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলও করে বিএনপি। কিন্তু দেড় মাসেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করতে পারেনি। কমিটি দিতে আরও কয়েক দিন বিলম্ব হতে পারে। জানা গেছে, এ নিয়ে সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা আর উৎকণ্ঠা আরও বাড়ছে।

সম্প্রতি তিন ধাপে ৪১ সদস্যের কমিটি দেওয়ার পরও দলের ভিতরে-বাইরে শুরু হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। অযোগ্যদের পদায়ন ও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনসহ নানা অভিযোগ নেতা-কর্মীদের। এ নিয়ে দলের ভিতরে নানা বিশৃঙ্খলা। নেতা-কর্মীরা এখন পূর্ণাঙ্গ কমিটির অপেক্ষা করছেন। নানা জটিলতায় কমিটি গঠন প্রক্রিয়াও আটকে আছে। নেতা-কর্মীদের দৃষ্টি শুধু এখন পূর্ণাঙ্গ কমিটির দিকে। ইউপি নির্বাচনে নেতা-কর্মীদের কোনো মনোযোগ নেই। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দলে পদ পেতে নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে। তা যদি প্রতিহিংসায় রূপ নেয় তাহলে ক্ষতি। একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে দোষারোপ বন্ধ করে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তাহলেই দল সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হবে।’ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিয়ে কৌশলগতভাবে হেরে গেছে। দাবি আদায়ের মতো আন্দোলনের ক্ষেত্রও তারা প্রস্তুত করতে পারেনি। এক্ষেত্রে আন্দোলনের কৌশলও ছিল ভুল। তাছাড়া হঠাৎ করে টানা আন্দোলনের ইতি টানাও ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তের পর দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু করায় নেতা-কর্মীদের মধ্যে চাঙ্গাভাব চলে আসে। এ ছাড়া স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে থাকার সিদ্ধান্তও ছিল ইতিবাচক। তবে কাউন্সিলের দেড় মাস পরেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি না দেওয়ায় নেতা-কর্মীদের মধ্যে  ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে কিছু অযোগ্যদের গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখার সিদ্ধান্তও সঠিক হয়নি বলে মনে করছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা। বিএনপির সিনিয়র নেতারা বলেন, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া চান দলকে একটি সুশৃঙ্খল প্লাটফর্মে দাঁড় করাতে। সর্বাত্মক চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। পরিবার-স্বজনহারা খালেদা জিয়ার নীরব-নিভৃত ভাবনা শুধুই দল নিয়ে। এই বয়সেও তিনি আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। একইভাবে লন্ডনে অবস্থান নেওয়া বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানেরও দল নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে দলের নানা বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন তিনি। তবে নেতা-কর্মীদের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস ক্রমান্বয়ে বাড়ছেই। বিশেষ করে সিনিয়র নেতাদের মধ্যে এ ধরনের প্রবণতায় তৃণমূল নেতৃত্বে হতাশা বাড়ছে। নতুন কমিটির আংশিক ঘোষণার পাশাপাশি স্থানীয় সরকারের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নেতারা একে অপরের প্রতি কাদা ছোড়াছুড়ি করে যাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিএনপিকে আর কত দিন অপেক্ষা করতে হবে— তা সময়ই বলে দেবে। তবে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি এখনো আন্দোলনে পরিণত করতে পারেনি দলটি। যদিও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তার বক্তৃতা-বিবৃতিতে নতুন নির্বাচনের দাবি করে আসছেন। বিদেশিরাও এখনো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পক্ষেই কথা বলছেন। আমি মনে করি, বিএনপি এখন যে স্ট্যাটেজিতে রয়েছে, তা ঠিকই আছে। দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত তারুণ্যনির্ভর কমিটি গঠন করে শক্তিশালী করতে হবে। এটাও আন্দোলনের পূর্ব প্রস্তুতি। তবে কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছে, সামনে যেন তা আর না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ বলেন, ‘২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনে না যাওয়ায় কৌশলগত ভুল করেছে বিএনপি। দলটির ওই সময় বিচক্ষণতার পরিচয় দেওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু তারা তা দেখাতে পারেনি। সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেদিন সংলাপে বসা উচিত ছিল। আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের প্রস্তাব দিলে মানুষেরও আগ্রহ তাদের প্রতি বাড়ত। সেদিন যে ফরমেটেই হোক না কেন, যদি বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিত, তখন যে জনমানুষের একটি ফ্লো হতো তা খুবই ইতিবাচক হতো। যদি ওই নির্বাচনে প্রচুর কারচুপি হতো, বিএনপিকে কেন্দ্রে যেতে দেওয়া হতো না, তাহলে অবস্থানটা আজকের এই অবস্থানের চেয়ে অনেক বেশি মজবুত হতো। সেখান থেকে তারা ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নিত, তাহলে নেতা-কর্মীরা তা আরও বেশি গ্রহণ করত। এখন বিএনপি দুর্বল হয়ে পড়েছে। ওই সময় সে অবস্থানে ছিল না। সব দিক দিয়েই বিএনপির জন্য বেদনাদায়ক।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপির এখন দেখা উচিত কীভাবে আস্থা অর্জন করে জনগণকে নানা কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করা যায়। দেশবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া যায়। সংগঠনকে গোছানোর ক্ষেত্রে সিনিয়র নেতাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। এক্ষেত্রে বিএনপি সমর্থিত শুভাকাঙ্ক্ষীদেরও মতামত নেওয়া যেতে পারে। কমিটি করার ক্ষেত্রে দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের সম্পৃক্ত করতে হবে। এককভাবে কারও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নূরুল আমিন বেপারি বলেন, ‘বিগত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে না গিয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে কীভাবে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন আদায় করা যায়, তা করতে পারেনি বিএনপি। ’৯৬ সালে যা আওয়ামী লীগ পেরেছিল। মনে রাখতে হবে, গণতান্ত্রিক অধিকার কেউ দেয় না, আদায় করে নিতে হয়। বিগত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে বিএনপি অনেক সুসংগঠিত ছিল। কিন্তু তারা ওই সময় নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে জামায়াতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। যা ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা বিশ্ব কেউই মেনে নেয়নি। আবার আন্দোলন হঠাৎ করে থামিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তও ভুল ছিল। এরপর প্রায় এক বছর বিএনপি আন্দোলন থেকে সরে আসে।’ বিএনপির বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান নূরুল আমিন বেপারি আরও বলেন, ‘অনেকেরই আশা ছিল, কাউন্সিলের মাধ্যমে বিএনপি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। কিন্তু এখনো বিএনপি পূর্ণাঙ্গ কমিটিই দিতে পারেনি, স্থায়ী কমিটিও সাজাতে পারেনি। বয়োবৃদ্ধ আর আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ থাকা স্থায়ী কমিটির নেতাদের সরাতে পারছেন না খালেদা জিয়া। তাদের ক্ষেত্রে জরুরি সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। পরীক্ষিত ও ক্লিন ইমেজের নেতাদের দলের সর্বোচ্চ ফোরামে রাখতে হবে। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় বিএনপি এগোচ্ছে তাতে সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রতি তৃণমূলের আস্থা না থাকলে দল মজবুত হবে না। তাছাড়া ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনেও বিএনপিকে মাঠে সক্রিয় থাকতে হবে। এত বড় অংকের রিজার্ভ চুরিসহ চলমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতেও বিএনপি একটি কর্মসূচিও দিতে পারেনি। মনে রাখতে হবে, আন্দোলন আর নির্বাচনী প্রক্রিয়া দুটোই বিএনপিতে অনুপস্থিত।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর