বুধবার, ৪ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

ফের সিঙ্গাপুরে জঙ্গি মিশন

আটক ৮ বাংলাদেশি, গোপন হামলার পরিকল্পনা

কূটনৈতিক ও নিজস্ব প্রতিবেদক

ফের সিঙ্গাপুরে জঙ্গি মিশন

ইসলাম শরিফুল, মামুন লিয়াকত আলী, জাবেদ কায়সার হাজী নুরুল ইসলাম সওদাগর, মিয়া রুবেল, জামান দৌলত, সোহেল হাওলাদার, সোহাগ ইব্রাহিম ও রহমান মিজানুর (ওপরে বাম থেকে)

‘ইসলামিক স্টেট ইন বাংলাদেশ’ বা আইএস-বি নামে বাংলাদেশি জঙ্গিদের গঠন করা একটি দলকে আটক করেছে সিঙ্গাপুরের পুলিশ। তারা বাংলাদেশের সামরিক-বেসামরিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, মন্ত্রী-এমপি, রাজনৈতিক নেতা, সরকারি কর্মকর্তা, সাংবাদিক ও বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর ওপর হামলার পরিকল্পনা করছিল। এই গ্রুপের সঙ্গে সম্পৃক্ত ১৩ জনকে গত মাসে আটক করা হয় সিঙ্গাপুরে। এর মধ্যে আটজনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকি পাঁচজনকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। গতকাল তাদের রাজধানীর বনশ্রী থেকে গ্রেফতার করেছে বাংলাদেশের পুলিশ। এর আগে ডিসেম্বরে সন্দেহভাজন ২৭ বাংলাদেশি জঙ্গিকে আটক করেছিল সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ। এবারের ১৩ জনকে নিয়ে সিঙ্গাপুরে এ পর্যন্ত মোট ৪০ সন্দেহভাজন বাংলাদেশি জঙ্গিকে আটক করা হলো। সিঙ্গাপুরে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মাহবুব উজ জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে দুই দেশ ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। সিঙ্গাপুরকে সহযোগিতা করছে বাংলাদেশ। কারণ বাংলাদেশ কোনোভাবেই জঙ্গিবাদ সমর্থন করে না। গতকাল সিঙ্গাপুর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আইনের অধীন এপ্রিলে আট বাংলাদেশি জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলেন— মিজানুর রহমান (৩১), লিয়াকত আলী মামুন (২৯), সোহাগ ইব্রাহিম (২৭), রুবেল মিয়া (২৬), দৌলতুজ্জামান (৩৪), শরিফুল ইসলাম (২৭), মো. জাবেদ কায়সার হাজি নুরুল ইসলাম সওদাগর (৩০) ও ইসমাইল হাওলাদার সোহেল (২৯)। এর মধ্যে মিজানুর ছিলেন দক্ষ শ্রমিকের জন্য নির্ধারিত এস-ভিসা ও অন্য সাতজন ওয়ার্ক পারমিটের ভিত্তিতে সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছিলেন এবং স্থানীয় কনস্ট্রাকশন ও মেরিন কারখানায় চাকরি করছিলেন। সিঙ্গাপুর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, গ্রেফতার ব্যক্তিদের মধ্যে মিজানুর সিঙ্গাপুরে গত মার্চে ‘ইসলামিক স্টেট ইন বাংলাদেশ (আইএসবি)’ নামে গোপন সংগঠন তৈরি করেন। আটক ব্যক্তিরা সবাই এর সদস্য। এ ছাড়াও এই গোষ্ঠীর অন্তত আরও দুজন সদস্য বাংলাদেশে রয়েছেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে। এ জঙ্গিরা মূলত সিরিয়ায় গিয়ে বিদেশি যোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধে যোগ দিতে আগ্রহী হলেও এটা দুঃসাধ্য হওয়ায় ভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। তারা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উত্খাত করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে খেলাফত কায়েমের পরিকল্পনা করে। মিজানুর রহমানের কাছে পাওয়া ‘আমাদের জিহাদ প্রয়োজন’ শীর্ষক একটি দলিলে বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তা ও সামরিক কর্মকর্তাদের একটি তালিকা পাওয়া গেছে। এ তালিকা ধরে আক্রমণের পরিকল্পনা ছিল এই জঙ্গি গ্রুপটির। এ ছাড়া তাদের কাছে যেসব অস্ত্র পাওয়া গেছে সেসবের সঙ্গে আইএস ও আল-কায়েদা সদস্যদের ব্যবহূত অস্ত্রের মিল রয়েছে। তারা সিঙ্গাপুরে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মধ্য থেকে সদস্য সংগ্রহ করছিলেন। সেই সঙ্গে দেশে ফিরে হামলা চালানোর লক্ষ্যে অস্ত্র কেনার জন্য তারা অর্থ জোগাড় করছিলেন। সিঙ্গাপুর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেই অর্থ জব্দ করেছে। মিজানুর তদন্ত কর্মকর্তাদের বলেছেন, আইএসের নির্দেশ পেলে তিনি দেশের যে কোনো জায়গায় হামলা চালাতেন। তবে সিঙ্গাপুরও হামলার লক্ষ্য ছিল কিনা, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, জঙ্গি সন্দেহে আরও পাঁচ বাংলাদেশিকে গ্রেফতার করা হলেও তাদের সঙ্গে আইএস-বির সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

সিঙ্গাপুর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রকাশ করা তালিকায় দেখা যায়, গ্রেফতার ব্যক্তিদের কাছে স্নাইপার রাইফেল চালানো ও বিস্ফোরক বানানোর বাংলা বই এবং হামলার লক্ষ্যবস্তুর তালিকা পাওয়া গেছে। লক্ষ্যবস্তুর তালিকায় রয়েছে— বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ, সিআইডি কর্মকর্তা, বিমান ও নৌবাহিনীর কর্মকর্তা, এমপি, মন্ত্রী, চেয়ারম্যান, সচিব পদমর্যাদার সরকারি কর্মকর্তা, সরকারের শীর্ষ নেতা, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, নাস্তিক, মুনাফিক হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিরা। সিঙ্গাপুর সরকার থেকে তালিকার ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করা হয়নি। ঢাকা মহানগর পুলিশ জানিয়েছে, হত্যাসহ সন্ত্রাসী হামলার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে ২৮ এগ্রিল পাঁচ বাংলাদেশিকে দেশে ফেরত পাঠায় সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ। গতকাল অভিযান চালিয়ে বনশ্রীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়েছে। তারা হলেন— মিজানুর রহমান ওরফে গালিব হাসান (৩৮), রাহা মিয়া পাইলট (২৯), আলমগীর হোসেন (২৯), তানজীমুল ইসলাম (২৪) ও মাসুদ রানা ওরফে সল্তু খান (৩১)। মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, গ্রেফতার পাঁচজন ২০০৭ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে সিঙ্গাপুরে যান। সেখানে গিয়ে তারা জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তারা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন। তাদের আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হবে। রিমান্ডে নেওয়ার পর পুরো বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে। এর আগে, গত ডিসেম্বরে আইএস ও আল-কায়েদার মতো উগ্র জঙ্গি সংগঠনগুলোকে সমর্থন করার অভিযোগে সিঙ্গাপুর সরকার ২৭ বাংলাদেশিকে গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে ২৬ জনকে জানুয়ারিতে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। এ ২৬ জনের মধ্যে ১৪ জন এখন কারাগারে।

সর্বশেষ খবর