শুক্রবার, ৬ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা
লেখকের অন্য চোখ

তোমার বাবা আমার ছাত্র ছিলেন

সমরেশ মজুমদার

তোমার বাবা আমার ছাত্র ছিলেন

পিতামহ আমাকে জলপাইগুড়ি জিলা স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন পাঁচ বছর বয়সে, কোনো পরীক্ষা বা ইন্টারভিউ দিয়ে নয়, হয়তো হেড-মাস্টার মশাইয়ের সঙ্গে আগে কথা বলে নিয়েছিলেন। সরাসরি সকাল ১১টায় স্কুলে নিয়ে গিয়ে যে ঘরটাতে পৌঁছে দিয়েছিলেন সেখানে আমার বয়সী ছেলেরা চুপচাপ বসেছিল। প্রধানমাস্টার মশাইকে পিতামহ বলেছিলেন, দিয়ে গেলাম। সেই মাস্টার মশাইয়ের নাম যে রমেশ দাশগুপ্ত তা পরে জেনেছিলাম। তিনি বললেন, ঠিক আছে। এসো হে। নাম কী? নাম জানার পর একটা জায়গা দেখিয়ে বলেছিলেন, ওইখানে বসো। তোমার বাবা এই আমার ছাত্র ছিলেন।

আমি ভয়ে ভয়ে দ্বিতীয় বেঞ্চিতে নিজের জায়গা করে নিতে চেষ্টা করতেই পাশের ছেলেটির খাতায় ধাক্কা খেলাম এবং সেটা নিচে পড়ে গেল। বিরক্ত মুখে ছেলেটি খাতাটা তুলতে তুলতে চাপা গলায় বলল,‘শা-লা’! আমার কান গরম হয়ে গেল, মুখে রক্ত জমল। শব্দটার মানে আমি জানি না। কিন্তু ওর মুখের অভিব্যক্তি ও উচ্চারণের বয়স দেখে মনে হয়েছিল কথাটা খুব খারাপ। দিন তিনেকের মধ্যেই জ্ঞানবৃদ্ধি হলো। দু-তিনটে ছেলে, যাদের গায়ের জোর অন্যদের চেয়ে বেশি তারা ঝগড়া করার সময় ‘শালা’ শব্দটা এমনভাবে উচ্চারণ করে যেন লাথি মারছে। সদ্য বন্ধু হওয়া একজন আমাকে গোপনে জানাল, ...কখনো বলিস না। ওটা খুব খারাপ গালাগাল। কাউকে দিতে হলে মনে মনে বলবি। ভোর চারটের সময় পিতামহ আমাকে বিছানা থেকে তুলে তৈরি করে মর্নিং ওয়ার্কে নিয়ে যেতেন। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষার দোহাই মানতেন না। ঘুম চোখে আমি বাধ্য হতাম তার সঙ্গে পেছনে হাঁটতে যতক্ষণ না সূর্যের চেহারা দেখা যায়। খুব কষ্ট হতো, কান্না পেত। ভয়ঙ্কর মানুষ মনে হতো পিতামহকে। স্কুলে ঢোকার পঞ্চম দিনের সকালে মন ভালো হয়ে গেল। আধো অন্ধকারে পিতামহের পেছনে হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে চিত্কার করে বললাম, শা-লা! বলামাত্র মনে হলো যে কষ্ট পাচ্ছি তা অনেকটা কমে গেল। পরদিন থেকে পা ফেলি আর মনে মনে শালা বলি। এক দিন ওইরকম করার সময় খেয়াল করিনি পিতামহ দাঁড়িয়ে গেছেন এবং আমায় লক্ষ করছেন। বোঝামাত্র আমি স্থির হলাম। পিতামহ জিজ্ঞেস করলেন, মনে মনে কী জপ করছ? দুর্গানাম? তোমার পিসিমাকে দেখে শিখেছ? ওসব জপ করার সময় তোমার এখনো হয়নি। পঞ্চাশ বছর পরে কর। আবার হাঁটতে শুরু করে নিজের মনে বললেন, এইটুকুনি ছেলে, দুর্গানাম জপছে। বছরখানেক পরে একদিন বেধড়ক মার খেলাম। পিতামহের বাড়ি থেকে চা-বাগানে বাবা-মায়ের কাছে গিয়েছিলাম স্কুলের ছুটিতে। পড়ার ঘরের জানালায় একটা কাক কোত্থেকে এসে ক্রমাগত চিত্কার করে যাচ্ছিল। কানে ওই কর্কশ আওয়াজ ঢুকলে পড়ায় মন বসে না। ওকে তাড়ানোর চেষ্টা করে যখন পারছিলাম না তখন একটা স্কেল জানালার দিকে ছুড়ে চিত্কার করে ধমকালাম, ...শালা! কে জানত বাবা পাশের বারান্দায় বসে কাগজ পড়ছেন? ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী বললি? তুই শালা বললি? তারপর আমার চুলের গোড়া পর্যন্ত মুঠোয় ধরে পড়ে থাকা স্কেল তুলে বেধড়ক মারতে লাগলেন। মারের সঙ্গে তার বলার সংলাপ ছিল এরকম— এই বয়সে তুমি গালাগাল শিখে ফেলেছ? ভালো স্কুলে ভর্তি হয়ে আগে খারাপগুলো রপ্ত করেছ? ছিঃ ছিঃ, তুমি আমাদের বংশের কলঙ্ক। মা এসে আমাকে প্রথমে রক্ষা করেন, যখন শুনলেন অপরাধটা কি,তখন ঠাস করে আমার গালে চড় মারলেন, অ্যাঁ, তুই, তুই গালাগাল দিয়েছিস! আমাদের বাল্যকালে শালা অত্যন্ত নোংরা শব্দ হিসেবে চিহ্নিত ছিল। ভদ্রসমাজে কেউ ওই শব্দ উচ্চারণ করে না। একটু বড় হয়ে আমার বন্ধু-বান্ধবরা শালা না বলে বলতাম এসএ এলএ। তাতে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটলেও মিটত। মেয়েদের গালাগাল ছিল একটাই— ‘অসভ্য’। তাই তারা খুব জোর দিয়ে বলত। প্রশ্ন হলো শালা কেন গালাগাল হলো? অভিধান বলছে, শালা একটি গালিবিশেষ। নতুবা তিনি পত্নীর ভাই। কেন গালিবিশেষ তার ব্যাখ্যা নেই। ধরে নেওয়া যেতে পারে কোনো এক পূর্বপুরুষের পত্নীর ভাই জ্বালিয়েছেন তার জামাইবাবুকে। সেই জ্বলুনি থেকে জামাইবাবুর মুখ থেকে বিদ্বেষে ছিটকে বেরিয়েছে— শালা! আমার এক আত্মীয় কখনোই তার স্ত্রীর ভাইকে শালা বলতেন না, বলতেন শ্যালক। সেটা নাকি শোভন হতো। তাহলে শালারা কি জামাইবাবুকে দোহন করতে পছন্দ করেন? তারা কি মনে করেন স্ত্রীর মুখ চেয়ে সেই জামাইবাবু প্রশ্রয় দেবেন? হয়তো। সেই বয়স থেকেই শব্দটা গালাগাল হয়ে গেল। কিন্তু আমরা যখন শালা শব্দটি গালাগাল হিসেবে ব্যবহার করতাম তখন বিয়ের প্রশ্নই ওঠেনি। তাহলে? পরে শালা শব্দটি তার গুরুত্ব হারাল। ওটা কথার লব্জ হয়ে গেল। কাউকে বোঝাতে যদি ‘দূর শালা’! তুই কিছুই বুঝিস না বলা হয় তাহলে যাকে বলা হচ্ছে সে গালাগাল হিসেবে নেয় না। তুই শালার পর আমি শালা একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম বাক্যটি অনায়াসে বলা শুরু হয়ে গেল। কলকাতার রকে যখন দুই অক্ষর বা চার অক্ষরের গালাগালি অম্লান বদনে রকবাজরা বলত না তখন শালা শব্দটি খইয়ের মতো ফুটত। এখন অবশ্য ওই দুই বা চার অক্ষরকেও রকবাজরা গালাগালি হিসেবে ভাবে না। মজার কথা হলো, গত কুড়ি বছরে একটু একটু করে মেয়েরাও শালা বলতে শুরু করল। স্কুল-কলেজের ছটফটে মেয়েরা পবিত্র মুখে শালা শব্দটা ব্যবহার করছে। তখন আর শালা স্ত্রীর ভাই নয়। শালা শব্দটি রেলের ইঞ্জিনের মতো বাক্যের অন্য শব্দগুলোকে এখন গতি সঞ্চার করে যাচ্ছে। শুধু বাংলা ভাষায় নয়, হিন্দিতেও শালা একটি গালাগাল। এখনো অপরিচিত বা অর্ধপরিচিত কেউ শব্দটি বললে হিন্দি ভাষাভাষী খেপে ওঠেন। আমাদের বাংলার মতো শালা ওদের কাছে এখনো মাহাত্ম্য হারায়নি।

সর্বশেষ খবর