সোমবার, ৯ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

রিজার্ভ ব্যাংকে কী হয়েছিল

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

রিজার্ভ ব্যাংকে কী হয়েছিল

ঘটনাস্থল যুক্তরাষ্ট্র : ৪ ফেব্রুয়ারি, বাংলাদেশ ব্যাংকের গোপন সংকেত (সুইফট কোড) ব্যবহার করে নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে একের পর এক ৭০টি পেমেন্ট পরিশোধের নির্দেশনা যাচ্ছে, যার মাধ্যমে ১ হাজার ৯২৬ দশমিক ০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে বলা হচ্ছে।

দৃশ্যপট-১ : তারিখ ৪ ফেব্রুয়ারি, মার্কিন সময় ১৭টা ৫৫ মিনিট। নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ বাংলাদেশ ব্যাংকে ‘এসি বেঙ্গল/০২০৪১৬’ নম্বরযুক্ত একটি মেসেজ পাঠায়, যেখানে ১২টি পেমেন্ট নির্দেশনা (পিআই) উল্লেখ করা হয়। প্রশ্ন ছিল উল্লিখিত পিআইগুলোর সুবিধাভোগী কে? অর্থাৎ পেমেন্টে নির্দেশিত ডলারগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে কার কাছে যাচ্ছে? (মেসেজে পেমেন্ট পরিশোধের কোনো তথ্য নেই)। দৃশ্যপট-২ : ৫ ফেব্রুয়ারি, মার্কিন সময় ১৬টা ০৯ মিনিট। ‘এসি বেঙ্গল/০২০৫১৬’ নম্বরযুক্ত আরও একটি মেসেজ পাঠানো হয় বাংলাদেশ ব্যাংকে। তাতেও আরও ৪টি পেমেন্ট পরিশোধ সংক্রান্ত নির্দেশনার (পিআই) তথ্য দিয়ে জানতে চাওয়া হয় ডলারগুলো কার কাছে কোথায় যাচ্ছে তার বিস্তারিত বিবরণ। (পেমেন্ট পরিশোধের কোনো  তথ্য নেই)। দৃশ্যপট-৩ : একই তারিখে মার্কিন সময় ১৬টা ৪৩ মিনিটে আরও ৩০টি পিআই নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে ফেডারেল রিজার্ভ ‘এসি বেঙ্গল/০২০৫১৬-২’ নম্বরযুক্ত চূড়ান্ত মেসেজ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়ে দেয়, ‘মেসেজে উল্লিখিত সুবিধাভোগীর বিষয়ে কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্য চাওয়া হয়েছে। চাহিদা মতো তথ্য প্রদান করা না হলে পেমেন্ট নির্দেশনাগুলো পরিশোধ করা হবে না।’ ঘটনাস্থল বাংলাদেশ : সুইফট-এর মাধ্যমে সম্পাদিত যাবতীয় লেনদেনের কপি বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট-এর সাথে সংযুক্ত প্রিন্টারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রিন্ট হওয়ার কথা থাকলেও আশ্চর্যজনকভাবে ৪ ফেব্রুয়ারির লেনদেনের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। ফলে ৪ ফেব্রুয়ারি ফেডারেল রিজার্ভ থেকে পাঠানো মেসেজ সম্পর্কে কিছু জানতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। পরদিন ৫ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার উল্লিখিত প্রিন্টারে স্বয়ংক্রিয় প্রিন্টিংয়ের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়। এই যান্ত্রিক ত্রুটি ওই দিন সারানো সম্ভবপর না হওয়ায় ৫ ফেব্রুয়ারিও ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ৬ ফেব্রুয়ারি শনিবার বিকল্প পদ্ধতিতে (নতুন প্রিন্টার স্থাপনের মাধ্যমে) হস্তচালিত বার্তা প্রিন্ট করা হয়। এরপর ওই বার্তাগুলো পরীক্ষা করার সময় ওই দিন বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথম জানতে পারে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ৩টি মেসেজে মোট ৩৫টি পিআই বা পেমেন্ট পরিশোধের নির্দেশনা দিয়ে ডলার লেনদেনের কিছু তথ্য চেয়েছে। এরপরই নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধান : ফেডারেল রিজার্ভের ৩য় মেসেজে যে ৩০টি পিআই সম্পর্কে তথ্য চাওয়া হয়েছিল সেখানে প্রথম মেসেজে উল্লিখিত অর্থাৎ ৪ ফেব্রুয়ারি পাঠানো প্রথম মেসেজের ১২টি পিআই সংযুক্ত ছিল। এর মানে হচ্ছে, ঘটনার শুরুর দিন ৪ ফেব্রুয়ারি যে পেমেন্ট নির্দেশনাগুলো গিয়েছিল, সন্দেহ হওয়ায় তা পরিশোধ করেনি ফেডারেল রিজার্ভ। এ কারণে ৩য় মেসেজে অন্য পিআইগুলোর সঙ্গে আবারও প্রথম দিনের ১২টি পেমেন্ট নির্দেশনা যুক্ত করে মোট ৩০টি পিআই সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। এই ৩০টি পিআই সম্পর্কে মেসেজ দিয়ে ফেডারেল রিজার্ভ বলেছিল, তথ্য না পেলে তারা পেমেন্ট পরিশোধ করবে না। এর মানে ৪ ফেব্রুয়ারি ১২টি পিআই বা পেমেন্ট নির্দেশনা পেয়েও সন্দেহ হওয়ায় অর্থ পরিশোধ করেনি ফেডারেল রিজার্ভ। পরদিন ৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় মেসেজে যে চারটি পিআই-এর তথ্য চাওয়া হয়েছিল তার পেমেন্ট পরিশোধ করা হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে তাত্ক্ষণিক বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করেনি ফেডারেল রিজার্ভ। পরে দেখা গেছে, মোট ৫টি পিআইর বিপরীতে মোট ১০১ মিলিয়ন অর্থ ছাড় করা হয়, যার মধ্যে ২০ মিলিয়ন ডলার শ্রীলঙ্কায় ও ৮১ মিলিয়ন ডলার ফিলিপাইনের একটি ব্যাংকে চারটি হিসাবে জমা হয়। যদি প্রথম থেকেই পেমেন্ট অর্ডারগুলো নিয়ে সন্দেহ থাকে এবং প্রথম মেসেজের ১২টি পেমেন্ট নির্দেশনা সন্দেহ হওয়ায় অর্থ ছাড় না করা হয়, তবে কেন পরের ৫টি পিআই-এর বিপরীতে অর্থ পরিশোধ করা হলো। এ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংককে কিছু জানায়নি ফেডারেল রিজার্ভ। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র শুভংকর সাহা এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে কিছু বলতে সম্মত হননি। অনুসন্ধানে জানা যায়, ফেডারেল রিজার্ভ ৪ ফেব্রুয়ারি পাঠানো প্রথম মেসেজে ১২টি পিআই-এর সুবিধাভোগী সম্পর্কে জানতে চাইলেও অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে বা হবে কিনা সে সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংককে কিছু জানায়নি। ৫ ফেব্রুয়ারি পাঠানো ২য় মেসেজেও সংশ্লিষ্ট পিআই-এর বিপরীতে অর্থ পরিশোধের ব্যাপারে কিছু জানায়নি তারা। একই দিন ৩য় মেসেজে উল্লিখিত ৩০টি পেমেন্ট নির্দেশনা (যার মধ্যে প্রথম মেসেজের ১২টি পিআই ছিল) উল্লেখ করে সুবিধাভোগীর তথ্য না পেলে অর্থ পরিশোধ করা হবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। এর সঙ্গে অপর একটি পৃথক ‘এমটি ১৯৯’ (অর্থ লেনদেন সম্পর্কে দুটি ব্যাংকের মধ্যে সুইফট মেসেজ প্রক্রিয়া) মারফত আরও ৩৫টি পিআই বা পেমেন্ট নির্দেশনা বাতিলের তথ্যও বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানো হয়। কিন্তু ওই মেসেজটি বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফটে পৌঁছায়নি। ফলে ৬ ফেব্রুয়ারি এ সম্পর্কে জানা যায়নি। পরবর্তীতে ফেড রিজার্ভের সঙ্গে যোগাযোগের পর এ ব্যাপারে অবহিত হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, সুইফট সিস্টেম ব্যবহার করে কোনো মেসেজ পাঠানো হলে ওই মেসেজের কপি সার্ভারে থেকে যায় এবং রিসিভিং ব্যাংক ওই পেমেন্ট পরিশোধ করলে প্রতিটি পেমেন্টর বিপরীতে পৃথক খরচের হিসাবের নিশ্চয়তা (ডেবিট কনফার্মেশন) বার্তা পাঠায়। প্রতিটি সফল লেনদেনের সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদনে একটি স্টেটমেন্ট পাঠায় যা ‘এমটি ৯৫০’ নামে পরিচিত। কিন্তু ৪ ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর ৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা সুইফট সিস্টেমে ফেডারেল রিজার্ভের পাঠানো মেসেজগুলোর কোনো ডেবিট কনফার্মেশন পাননি। ‘এমটি ৯৫০’ পাওয়া গেলেও সেটি ‘করাপটেড’ ছিল এবং তা কোনোভাবেই খোলা বা পড়া যায়নি। এসব বিষয় থেকে কি প্রমাণ হয় যে রিজার্ভ চুরি বা হ্যাকের ঘটনায় ফেডারেল রিজার্ভের ‘দায়’ বা কোনো ধরনের ‘অবহেলা’ ছিল?— এমন প্রশ্নে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র শুভংকর সাহা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ ব্যাপারে আমরা এখন কিছু বলতে চাই না। আগামী ১০ মে সুইজারল্যান্ডের ব্যাসেলে ফেডারেল রিজার্ভ, সুইফট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ত্রিপক্ষীয় বৈঠক রয়েছে। সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর অর্থ চুরির ব্যাপারে আমাদের পর্যবেক্ষণ এবং তা উদ্ধারের ব্যাপারে আলোচনা করবেন।

সর্বশেষ খবর