মঙ্গলবার, ১০ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

যে প্রশ্নের উত্তর দেয়নি ফেডারেল রিজার্ভ

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

যে প্রশ্নের উত্তর দেয়নি ফেডারেল রিজার্ভ

রিজার্ভ চুরির ঘটনার চার দিন পর ৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে সব প্রকার লেনদেন সাময়িকভাবে ‘ব্লক’ করে দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয় নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভকে। ৯ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টায় ফেডারেল রিজার্ভের সঙ্গে একটি টেলি কনফারেন্স করে বাংলাদেশ ব্যাংক। যার মাধ্যমে পরবর্তী অ্যাকাউন্ট পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি নতুন ‘নিরাপত্তা চুক্তি’র বিষয়ে দুই পক্ষ একমত হয়। ওই দিন টেলি কনফারেন্সে প্রথমবারের মতো ফেডারেল রিজার্ভকে প্রশ্ন করে বাংলাদেশ ব্যাংক, যথাযথ নিশ্চয়তা ছাড়াই কেন অননুমোদিত ৫টি পেমেন্ট নির্দেশনার (পিআই) বিপরীতে ১০১ মিলিয়ন ডলার ছাড় করে দেওয়া হলো? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয়নি ফেডারেল রিজার্ভ। এরপর আরও একাধিকবার চিঠি, টেলি কনফারেন্স ও ই-মেইলে বার্তা পাঠিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ওই প্রশ্নের উত্তর চাইলেও ফেড রিজার্ভ তার জবাব দেয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, ‘ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া উচিত ছিল নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভের। এখনো পর্যন্ত সেটি না করে তারা ফল্ট করেছে। এর কারণ হচ্ছে অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রে তাদের কার্যক্রম পুরোপুরি সঠিক ছিল না। ৩৫টি পেমেন্ট ইনস্ট্রাকশন নিয়ে সন্দেহ হওয়ার পর তারা মেসেজ পাঠিয়েছিল, এরপর তারা ৩০টি পেমেন্ট বন্ধ করে কেন ৫টি পেমেন্ট ছাড় করল সেটিই বড় প্রশ্ন। আর এক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভিত্তি রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের।’ অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৮ ফেব্রুয়ারি তখনকার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভের প্রেসিডেন্টকে একটি পৃথক চিঠি লিখে সংশ্লিষ্ট ঘটনা নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব রাখেন। ছয় দিন পর ২৪ ফেব্রুয়ারি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের কাছে আরও একটি চিঠি পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে ৫টি অননুমোদিত পেমেন্ট নির্দেশনার বিষয়ে  ফেডারেল রিজার্ভের ব্যাখ্যা চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক উল্লেখ করে, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের রক্ষিত অ্যাকাউন্ট থেকে অননুমোদিত পিআই-এর মাধ্যমে অর্থ ছাড় করার পর ৮ ফেব্রুয়ারি (ফিলিপাইনের যে ব্যাংকে অর্থ স্থানান্তর হয়েছিল) ওই অর্থ ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে বার্তা দিয়েছিল ফেডারেল রিজার্ভ। এর পরও ৯ ফেব্রুয়ারি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক অর্থ ছাড় করে দেয়। আমরা (বাংলাদেশ ব্যাংক) মনে করি, ফেডারেল রিজার্ভ ওই অর্থ ছাড় করা থেকে বিরত থাকার জন্য যদি প্রত্যক্ষভাবে আরও বেশি চাপ সৃষ্টি করত, তবে রিজার্ভের অর্থ ফেরত পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যেত।’ একই চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক আরও উল্লেখ করে, ‘আমাদের মধ্যে যে দীর্ঘকালীন সম্পর্ক সেটি গড়ে উঠেছে নির্ভরশীলতা ও ঝুঁকি মোকাবিলায় ফেডারেল রিজার্ভের সযত্ন প্রতিশ্রুতির ওপর ভিত্তি করে। তবে অননুমোদিত পিআই-এর বিপরীতে অর্থ ছাড় করার পর ওই অর্থ উদ্ধারে প্রত্যক্ষ চাপ সৃষ্টি না করে ফেডারেল রিজার্ভ যে ভূমিকা রেখেছে, সেটি আমাদের জন্য উদ্বেগজনক।’ উপরের এই বার্তা থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, অর্থ ছাড় করার পর হ্যাকিংয়ের ঘটনাটি টের পেয়ে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ডলার ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছিল। তারা মৌখিকভাবে বা সরাসরি কোনো চাপ সৃষ্টি করেনি ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংকের ওপর, যে ব্যাংকটিতে চুরির ৮১ মিলিয়ন ডলার জমা হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা মনে করেন, নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ যদি প্রত্যক্ষভাবে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকের ওপর চাপ সৃষ্টি করত তবে চুরিকৃত ডলার আটকানো সম্ভব হতো। কারণ রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংক অর্থ ছাড়ের আগেই হ্যাকের বিষয়টি জানতে পেরেছিল ফেড রিজার্ভ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের বিরুদ্ধে অন্তত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ তুলতে পারে, (১). ফেডারেল রিজার্ভ গ্রাহক ব্যাংকের (বাংলাদেশ ব্যাংক) অননুমোদিত পেমেন্ট নির্দেশনা ছাড়ের ক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া সঠিকভাবে অনুসরণ করেনি। (২). অর্থ ছাড়ের পর যখন জানতে পারল সেটি হ্যাক হয়েছে, তখন ওই অর্থ ফেরত পাওয়ার  ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেনি। আর তৃতীয় অভিযোগটি আরও গুরুতর। সেটি হচ্ছে— ফেডারেল রিজার্ভ বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অননুমোদিত পিআই-এর বিপরীতে অর্থ ছাড়ের ব্যাখ্যা চেয়ে পাঠানো চিঠির কোনো জবাব দেয়নি। ফেডারেল রিজার্ভের এই ভূমিকার বিষয়টি জাতীয় সংসদকেও অবহিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ২ মে জাতীয় সংসদের সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটিকে দেওয়া এক প্রতিবেদনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক উল্লেখ করেছে, ‘উল্লিখিত চিঠির (২৪ ফেব্রুয়ারি যেটি পাঠানো হয়) জবাব নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অদ্যাবধি প্রেরণ করেনি।’ এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত টেলি কনফারেন্সের মাধ্যমে এবং ই-মেইলে বার্তা পাঠিয়েও উত্তর দেওয়ার জন্য ফেডারেল রিজার্ভকে অনুরোধ জানানো হয় বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে একাধিকবার যোগাযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ফেডারেল রিজার্ভ শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ও সুইফটকে নিয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বসতে সম্মত হয়েছে, যেটি আজ সুইজারল্যান্ডের ব্যাসেলে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে ফেডারেল রিজার্ভের সঙ্গে আলোচনায় আমরা আমাদের ইস্যুগুলো তুলে ধরব। সেসব ইস্যুর জবাব সেখানে পাওয়া যাবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সর্বশেষ খবর