বুধবার, ১১ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

বাংলাদেশিদের বিষয়ে ত্রিমুখী তদন্ত

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

বাংলাদেশিদের বিষয়ে ত্রিমুখী তদন্ত

নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এক দেশ থেকে টাকা অন্য দেশে পাচার করার তথ্য সংবলিত ‘পানামা পেপারসে’র দ্বিতীয় কিস্তিতে ২৪ বাংলাদেশি ব্যক্তি ও তিনটি প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে। এর মধ্যে বিমান বাংলাদেশ ইনকরপোরেশন ও কয়েকজন ব্যবসায়ী আছেন। নতুন পাওয়া এই ব্যক্তিদের সঙ্গে তিন বছর আগে একই ধরনের আরেকটি তথ্য ফাঁস ‘অফশোর লিকস’-এ নাম থাকা বাংলাদেশিদের বিষয়েও ঢাকায় শুরু হচ্ছে ত্রিমুখী তদন্ত। সবমিলিয়ে ৪২টি বাংলাদেশি ঠিকানা ব্যবহার করে দুই তথ্য ফাঁসে থাকা ৫৬ বাংলাদেশির বিষয়ে তদন্ত শুরু করতে যাচ্ছে দুদক, এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে তথ্য ফাঁস করা সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘তালিকায় নাম থাকা মানে অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন নয়। তবে এই ব্যক্তিরা প্রচলিত আইনের ফাঁক খুঁজে অর্থ পাচার করেছেন।

কর ফাঁকি দিয়ে সম্পদ পাচারের নেপথ্যে থাকা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দুই লাখের বেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম সোমবার মধ্যরাতে প্রকাশ করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (আইসিআইজে)। এতে দেশভিত্তিক ডাটাবেজে নতুন ব্যক্তি, তাদের অফশোর প্রতিষ্ঠানের নাম, নিবন্ধনের স্থান, বর্তমান অবস্থা ও প্রতিষ্ঠানে তাদের ভূমিকা কী সেসব তথ্য উল্লেখ করা হয়। বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা না হলেও নাম প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন বেনামি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ততার ধরন উল্লেখ করা হয়েছে। পানামার আইনি প্রতিষ্ঠান মোসাক ফনসেকার বিপুল সংখ্যক এ নথিতে অনেক রাষ্ট্রনেতারও অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে অর্থ পাচারের তথ্য এসেছে। এই ব্যক্তি ও কোম্পানিগুলোর মধ্যে ২ লাখ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ১৯৭৭ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কোনো না কোনো সময় মোসাক ফনসেকার গ্রাহক ছিলেন। বাকি ১ লাখের বেশি কোম্পানি ফনসেকার মতোই অর্থ পাচারে বুদ্ধিদাতা ও প্রক্রিয়ায় সহায়তা করা অন্য দুটি প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক। সর্বশেষ প্রকাশ হওয়া তালিকায় বাংলাদেশিদের মধ্যে আছেন (এবারের তালিকায়) সিটিসেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও গ্রামীণফোনের সাবেক প্রধান কমার্শিয়াল অফিসার মেহবুব চৌধুরী, আইজিডব্লিউ অপারেটর সেল টেলিকমের কফিল এইচ এস মুয়ীদ, এক্সেসটেলের মালিক জাইন ওমর, কিউবির পার্টনার আফজালুর রহমান। আরও আছেন মল্লিক সুধীর, মো. ইউসুফ রায়হান রেজা, বেনজির আহমেদ, ইসরাক আহমেদ, নভেরা চৌধুরী, বিলকিস ফাতিমা, ফরহাদ গনি মোহাম্মদ, মো. আবুল বাশার, নিজাম এম সেলিম, মোহাম্মদ মোকসেদুল ইসলাম, সরকার জীবন কুমার, মো. মোতাজ্জারুল ইসলাম ও মো. সেলিমুজ্জামান। তাদের প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এর বাইরে রজার বার্ব, ‘দি বিয়ারার’, পেসিনা স্টেফানো, রুডি বেনজামিন নাম ব্যবহার করে শেল কোম্পানিতে যুক্ত হওয়া অন্তত চারজনের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ আছে পানামা পেপারসে। এ ছাড়া সর্বশেষ প্রকাশ হওয়ায় তালিকায় বাংলাদেশের ১৪টি ঠিকানা ব্যবহার করে বিদেশি ব্যক্তিদের নামে অফশোর কোম্পানির শেয়ার কেনা হয়েছে। এর আগে ২০১৩ সালের এপ্রিলে একই ধরনের কাজে যুক্তদের নিয়ে আইসিআইজের প্রকাশ করা অফশোর লিকস এ নাম আছে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাফর উল্যাহ ও নীলুফার জাফর উল্যাহ, বাংলাট্র্যাকের মালিক আমিনুল হক, তার ছেলে নাজিম আসাদুল হক ও তারিক একরামুল হক। অফশোর লিকসের তথ্য ভাণ্ডারে আরও নাম আছে— দিলীপ কুমার মোদি, কাজী রায়হান জাফর, মাহতাবউদ্দিন চৌধুরী, সৈয়দা সামিনা মির্জা, উম্মে রুবানা, সালমা হক, আসমা মোনেম, এ এস এম মহিউদ্দিন মোনেম, সৈয়দ সেরাজুল হক, এফ এম জুবাইদুল হক, ক্যাপ্টেন এম এম জাউল, মোহাম্মদ শহীদ মাসুদ, খাজা শাহাদত উল্লাহ, মোহাম্মদ ফয়সাল করিম খান, মোহাম্মদ শহীদ মাসুদ, জুলফিকার হায়দার, মির্জা এম ইয়াহিয়া, মো. নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম, এফ এম জুবাইদুল হক, এ এফ এম রহমাতুল বারী, খাজা শাহাদাত উল্লাহ প্রমুখ। এই দুই কেলেঙ্কারিতে ব্যক্তিদের বাইরে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের নামও এসেছে। পানামা পেপারসে আছে বাংলাদেশ বিমান ইনকরপোরেশন, ইসলামিক সোলিডারিটি শিপিং কোম্পানি ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল এজেন্সিস কোম্পানি লিমিটেডের নাম। অফশোর লিকসে আছে এসরার বাংলাদেশ হোল্ডিং প্রাইভেট লিমিটেড ও টেলিকম ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড। বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে দুটি অফশোর প্রতিষ্ঠান জড়িত থাকার কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো— সোয়েন ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও সেভেন সি’জ অ্যাসেটস লিমিটেড। দুটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই গুলশান-২ এর একই ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। আর প্রতিষ্ঠান দুটিতে সংশ্লিষ্ট দুজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তারা হলেন স্টেফান পিরকার ও রুখসানা পিরকার। মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নাম আছে দিলিপ কুমার মোদি, বিবিটিএল ও স্টিফান পিরকারের নাম।

দুদক সচিব আবু মো. মোস্তফা কামাল গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, ফাঁস হওয়া তথ্যের সত্যতা নিরূপণে দুদকের তদন্ত দল জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তারা কোনো অবৈধ উপায়ে সম্পদ আহরণ করেছেন কিনা তা নিয়ে বিস্তারিত তদন্ত হবে। এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকেও তদন্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে এ বিষয়ে প্রকাশ্য ঘোষণা আসতে পারে। এনবিআরের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, করফাঁকির বিষয়গুলো অভ্যন্তরীণভাবে খতিয়ে দেখবে এনবিআর। যে কোনো ধরনের ত্রুটি পেলে আইনের আওতায় আনা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক পুরো আর্থিক প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের কোনো সম্পদ বা অর্থ পাচার হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা ইতিমধ্যেই শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র।

সর্বশেষ খবর