শুক্রবার, ২০ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

পশ্চিমবঙ্গ কাঁপিয়ে ফের মমতার জয়

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

পশ্চিমবঙ্গ কাঁপিয়ে ফের মমতার জয়

প্রতিদ্বন্দ্বীদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তারাই ক্ষমতায় আসছেন। কিন্তু গোটা পশ্চিমবঙ্গ মাতিয়ে আবারও ক্ষমতায় ফিরে এলো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস। গতকাল রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে ভোট গণনার পর রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায় মোট ২৯৪ আসনের মধ্যে ২১১টিতে জিতেছে তৃণমূল। বাম-কংগ্রেস জোট পেয়েছে ৪৪টি আসন। বামফ্রন্ট পেয়েছে ৩২, বিজেপি ৩ এবং অন্যান্য ৪। মমতা দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুর আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী জোট প্রার্থী কংগ্রেসের দীপা দাসমুন্সিকে ২৫ হাজার ৩০১ ভোটে হারিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন যদিও জেতার ব্যবধান গতবারের চেয়ে অনেক কম। তৃতীয় হয়েছেন বিজেপির হেভিওয়েট প্রার্থী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সদস্য নেতাজির নাতি চন্দ্রকুমার বসু। ২০১১ সালের বিধানসভার উপনির্বাচনেও এই ভবানীপুর কেন্দ্র থেকে জিতেছিলেন মমতা। সেবার সিপিআইএম প্রার্থী অধ্যাপিকা নন্দিনী মুখোপাধ্যায়কে ৫৪ হাজার ২১৩ ভোটে হারিয়ে জয়লাভ করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী। জোটের ধাক্কায় পরাজিত হয়েছেন রাজ্যের আরও একাধিক মন্ত্রী। এর মধ্যে রয়েছেন আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। ৬ হাজার ৩২৪ ভোটে সিপিআইএমের তন্ময় ভট্টাচার্যের কাছে হেরেছেন তিনি। পরাজিত হয়েছেন খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ মন্ত্রী কৃষেন্দু নারায়ণ চৌধুরী, দফতরবিহীন মন্ত্রী সাবিত্রী মিত্র, সমবায়মন্ত্রী শঙ্কর চক্রবর্তী, বস্ত্রমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। তৃণমূলের সেলিব্রিটি প্রার্থীদের মধ্যে বারাসত কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছেন তৃণমূলের অভিনেতা দীপক (চিরঞ্জিৎ) চক্রবর্তী। রায়দিঘি কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের অভিনেত্রী প্রার্থী দেবশ্রী রায় টানা দ্বিতীয়বারের জন্য জয়ী হয়েছেন। চন্দননগর থেকে তৃণমূলের টিকিটে জয় পেয়েছেন গায়ক ইন্দ্রনীল সেন। তবে প্রথমবারে নির্বাচনী ময়দানে নেমেই পরাজয়ের স্বাদ পেলেন তৃণমূলের অভিনেতা প্রার্থী সোহম চক্রবর্তী। সিপিআইএমের সুজিত চক্রবর্তীর কাছে ৬১৬ ভোটে হারেন সোহম। চাঁচোল থেকে হেরেছেন তৃণমূলের গায়ক প্রার্থী সৌমিত্র রায়।

জয়ের আভাস পেয়েই বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ সবুজ পাড়ে সাদা শাড়ি পরে বাসার বাইরে বেরিয়ে অপেক্ষমাণ উত্সুক জনতার সঙ্গে হাত মেলান, নমস্কার জানান তৃণমূল নেত্রী। পাল্টা শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি দিয়ে মমতাকেও স্বাগত জানান সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে দলীয় কর্মী-সমর্থকরা। এরপর ১২টার কিছু আগে দলীয় কার্যালয়ে ঢুকে সংবাদ সম্মেলন করেন তৃণমূল নেত্রী। সঙ্গে ছিলেন দলের লোকসভার সদস্য মুকুল রায়, ডেরেক ওব্রায়েন, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, দীপক অধিকারী (দেব), চিত্র পরিচালক রাজ চক্রবর্তী। সংবাদ সম্মেলনে রীতিমতো খোশমেজাজে ছিলেন দলনেত্রী। দলের কার্যালয়ে তখন দেশ-বিদেশের নামি গণমাধ্যমের হুড়োহুড়ি। কার্যালয়ে ঢুকেই ভি-সাইন (বিজয় চিহ্ন) দেখান মমতা। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, এ জয় উন্নয়ন ও জনতার জয়। মমতা বলেন ‘এটা মা-মাটি-মানুষের ম্যাজিক। যারা ভেবেছিলেন উল্টে দেব, মানুষ তাদের বুঝিয়ে দিয়েছে। বাংলার মানুষ সব কুৎসা, প্ররোচনার জবাব দিয়েছে।’ মমতা ব্যানার্জি জানান, নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নেবে ২৭ মে। আজ শুক্রবার রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠির কাছে গিয়ে সরকার গঠনের দাবি জানাবে তৃণমূল। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হবে রেড রোডে, রাজভবনে নয়। এটা করা হবে সাধারণ মানুষ যাতে নিজেদের এই জয়ের সঙ্গী বলে অনুভব করতে পারে সেজন্য।

বিখ্যাতদের ভরাডুবি : পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম সম্পাদক বাম-কংগ্রেস জোট নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র মেদেনীপুর জেলার নারায়ণগড় আসনে তৃণমূল প্রার্থী প্রদ্যুৎ ঘোষের কাছে ১৩ হাজার ৫০০ ভোটে হেরে গেছেন। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত মমতা মন্ত্রিসভার পরিবহনমন্ত্রী মদন মিত্র কারাবন্দী তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়ে গেছেন। সারদা আর্থিক কেলেঙ্কারির দায়ে অভিযুক্ত মদন দুই বছর ধরেই কারাগারে, তিনি ৪ হাজার ৬৪ ভোটে হেরে গেছেন সিপিএম প্রার্থী মানস মুখার্জির কাছে। একইভাবে হেরে গেছেন বিদ্যুত্মন্ত্রী মনিশ গুপ্ত। যাদবপুর আসনে তাকে হারিয়েছেন সিপিএমের সুজন চক্রবর্তী। ২০১১ সালে এই মনিশ সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টচার্যকে হারিয়ে হিরো বনে যান এবং গুরুত্বপূর্ণ দফতর বিদ্যুতের মন্ত্রী হন।

মোদির অভিনন্দন : বিজয়ী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে টেলিফোনে অভিনন্দন জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি, অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন এবং দেশের বিশিষ্টজনরাও অভিনন্দন জানিয়েছেন। এদের সবাইকে ধন্যবাদ জানান মমতা।

গোপন আঁতাত? : বাম-কংগ্রেস জোট নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, তৃণমূলের অভাবনীয় জয়ের পেছনে রয়েছে ওই দলটির সঙ্গে বিজেপির গোপন সমঝোতা। সিপিএমের পক্ষ থেকে আলাদা এক বিবৃতিতে বলা হয়, তারা এবার থেকে সরকারের গঠনমূলক বিরোধিতা করবেন। কংগ্রেসও এ পরাজয় মেনে নিয়েছে। দলের রাজ্য সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী জানান, ‘মানুষের কাছে জোটের বিশ্বাসযোগ্যতা পৌঁছায়নি বলেই এই হার হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও দলীয় বৈঠকে এই হারের কারণ খোঁজা হবে বলে জানান তিনি।

জয়ললিতার বিজয় : সব বুথফেরত জরিপকে ভুল প্রমাণিত করে তামিলনাড়ুতে এবারও ক্ষমতায় এলো জয়ললিতার অল ইন্ডিয়া আন্না মুনেত্রা কাঝাগাম (এআইএডিএমকে)। নির্বাচনী প্রচারণায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ইঙ্গিত থাকলেও করুণানিধির দ্রাবিড়া মুনেত্রা কাঝাগাম (ডিএমকে)-কে উড়িয়ে দিয়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসতে চলেছেন ভারতীয় রাজনীতির আম্মা।

রাজ্যের ২৩৪টি আসনের মধ্যে এআইডিএমকে ৪৩টি আসনে জিতেছে, এগিয়ে রয়েছে ৮৩ আসনে। অন্যদিকে ২৯ আসনে জিতেছে ডিএমকে, এগিয়ে রয়েছে আরও ৭৫ আসনে। জয়ী প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন এআইএডিএমকে নেত্রী জয়ললিতা, ডিএমকের প্রধান এম করুণানিধি, দেশিয়া মুরপোক্কু দ্রাবিড়া কাঝাগাম (ডিএমডিকে) প্রধান বিজয়কান্ত প্রমুখ।

আসামে কংগ্রেসের হার : তিনবারের কংগ্রেসশাসিত সরকারকে পরাজিত করে এই প্রথম রাজ্যটিতে ক্ষমতায় আসার পথ মসৃণ করল বিজেপি (বিজেপি, আসাম গণপরিষদ (অগপ) ও বোড়োল্যান্ড পিপলস ফ্রন্ট (বিপিএফ)-এর সম্মিলিত জোট। ১২৬ আসনের মধ্যে বিজেপি জোটের দিকে গেছে ৪৫টি, এগিয়ে রয়েছে আরও ৪৪ আসনে। ১৩টি আসনে জিতেছে কংগ্রেস, এগিয়ে রয়েছে আরও ৮ আসনে। আরেক প্রতিপক্ষ অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এআইইউডিএফ) জয় পেয়েছে মাত্র ৪টি আসনে, এগিয়ে আছে ১০টিতে। জয়ী হেভিওয়েট প্রার্থীদের মধ্যে আছেন বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেস নেতা তরুণ গগৈ, বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী সর্বানন্দ সোনোয়াল। তবে পরাজিত হয়েছেন এআইইউডিএফ প্রধান বদরুদ্দিন আজমল।

কেরল : ১৯৭৭ সাল থেকেই নিয়ম করে এ রাজ্যের প্রতিটি বিধানসভায় সরকার পাল্টাচ্ছে। এবারও সেই রাজনৈতিক ধারা বজায় থাকল। জরিপকে সঠিক প্রমাণিত করে কেরলে ক্ষমতায় এলো বাম নেতৃত্বাধীন লেফটফ্রন্ট ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এলডিএফ)। ১৪০ আসনের মধ্যে তারা ৭৬টিতে জয় পেয়েছে, ৮টি আসনে এগিয়ে রয়েছে। ক্ষমতাসীন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউডিএফ) জোট পেয়েছে ৪২ আসন, এগিয়ে রয়েছে ৪টিতে। জয় পেয়েছেন বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেসের ওমান চণ্ডী, রাজ্যটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ চেনিথালা, সিপিআইএম নেতা সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ভি এস অচ্যুতানন্দ, সিপিআইএমের পিনারাই বিজয়ন, বিজেপি প্রার্থী সাবেক ভারতীয় ক্রিকেটার শ্রীশান্ত।

পুডুচেরি : ৩০ আসনবিশিষ্ট এই কেন্দ্রশাসিত রাজ্যে মূল লড়াই ছিল দুই জোটের মধ্যে। ক্ষমতায় থাকা অল ইন্ডিয়া এন আর কংগ্রেস ও এআইএডিএমকে জোটকে হারিয়ে ক্ষমতায় এসেছে বিরোধী ডিএমকে-কংগ্রেস জোট। এ জোটের দখলে গেছে ১৮টি আসন।

সর্বশেষ খবর