মঙ্গলবার, ২৪ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

কিলিং মিশনের ভয়ঙ্কর নেটওয়ার্ক

সাখাওয়াত কাওসার

কিলিং মিশনের ভয়ঙ্কর নেটওয়ার্ক

ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে কিলিং মিশনের নেটওয়ার্ক। একের পর এক তাদের টার্গেট বাস্তবায়ন করছে নেটওয়ার্কের দুর্ধর্ষ সদস্যরা। তাদের কৌশলের কাছে বার বার পর্যুদস্ত হচ্ছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। হত্যাকাণ্ডের পরপরই বিভিন্ন ওয়েবসাইটে চলে আসছে আনসার আল ইসলাম, একিউআইএস এবং আইএসের দায় স্বীকার করা বার্তা। ব্লগার, বিদেশি নাগরিক, সাধু, ফাদার কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষক থেকে সমকামী অধিকার আন্দোলনকর্মী, এমনকি মসজিদের মুয়াজ্জিন ও ইমামও বাদ যাচ্ছেন না খুনের নিশানা থেকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একের পর এক টার্গেট কিলিং পুলিশ ও গোয়েন্দাদের ভাবিয়ে তুলেছে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে জনমনে। সাধারণ মানুষের দিন কাটছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রগুলো বলছে, দেশকে অস্থিতিশীল করা এবং সরকারকে বিব্রত করার জন্যই একের পর এক অপচেষ্টা চালাচ্ছে কুচক্রী মহল। তবে তাদের রুখে দিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা রয়েছেন তত্পর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, স্পর্শকাতর এসব হত্যাকাণ্ডের তদন্তে লম্বা সময় নিলে চলবে না। কোনো হত্যাকাণ্ডকেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করলে চলবে না। দ্রুততর সময়ের মধ্যে অন্তত দু-একটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এতে অন্য অপরাধীরা ভয় পাবে। নেপথ্য মদদদাতারাও তাদের পলিসি থেকে সরে আসতে বাধ্য হবে। তিনি আরো বলেন, পুলিশের নবগঠিত কাউন্টার টেররিজম ইউনিট চাঞ্চল্যকর এসব হত্যাকান্ডের খোলস উন্মোচন করবে বলে আমি বিশ্বাস করতে চাই। তবে একইসঙ্গে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটাতে হবে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা সৃষ্টিকর্তা এবং নবী রাসুলদের নিয়ে কটুক্তি করে এবং যারা ইসলামের ক্ষতিতে লিপ্ত তাদেরকে কতল করতে পারলেই বেহেশ্ত নিশ্চিত—এমন মন্ত্রেই উদ্ধুদ্ধ করা হয় সহজ সরল শিক্ষিত যুবকদের। তবে অনেক ক্ষেত্রেই উদ্ধুদ্ধ ওই যুবকেরা নানা গ্রুপে সক্রিয় থাকলেও একে অপরকে চেনে না। অপারেশনের আগে বিভিন্ন উদ্ধুদ্ধকরণ বৈঠক কিংবা প্রশিক্ষনে অংশ নেওয়া গ্রুপের (স্লিপার সেল) সদস্যরা অপর সদস্যদের কাছে নিজের পরিচয় গোপন রেখেই কাজ করে। খোদ সমন্বয়কারীও তার পরিচয় গোপন রাখে স্লিপার সেলের সদস্যদের কাছে। একই কৌশলে থাকেন অর্থদাতাও। তবে নেপথ্য মদদদাতার সঙ্গে সমন্বয়কারীর যোগাযোগ হয়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের যোগাযোগ হয় দেশের বাইরে কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে। মদদদাতাই অর্থদাতার মাধ্যমে রেকি টিম বা অপরাধ সংগঠনকারীর কাছে অর্থ পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। সূত্র আরো বলছে, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই হত্যাকান্ডে ব্যবহার করা হচ্ছে চাপাতি। কিলিং মিশন সম্পন্ন করার পর দ্রুত সটকে পড়ার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে মোটরসাইকেল। আত্মরক্ষার জন্য প্রতিটি টিমেই রাখা হয় আগ্নেয়াস্ত্র। গোয়েন্দাদের ধোঁকা দিতে রেকি কিংবা অপারেশনে কিলারদের সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোনে কোন সীম থাকে না। মোবাইল ফোনও থাকে নম্বরবিহীন। গত দুই বছরে বিভিন্ন হত্যাকান্ডের তদন্তে গিয়ে গোয়েন্দারা এ বিষয়টি আবিষ্কার করেন। ঘটনাস্থলের টাওয়ারের প্রায় সবগুলো কল বিশ্লেষন করেই এ বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন তারা। অপরাধীরা টার্গেটের অবস্থান নিশ্চিত করতে ভিক্টিমের আবাসস্থল, চাকরিস্থল এবং আড্ডার জায়গা রেকি করে। এ জন্য নামানো হয় একাধিক টিম। কিলিং মিশনের দৃশ্যমান একটি টিম অংশ নিলেও অপর টিমগুলো মাঠে থাকে বেকআপ হিসেবে। আবার ঘটনাস্থলের আশেপাশে অবস্থানরত ব্যক্তিদের নজর এড়াতে তারা টার্গেটকৃত ব্যক্তির খুবই পরিচিত এমন আচরণ করে মোবাইল ফোনে বিরামহীন কথা বলতে থাকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, সরকারের কড়া নজরদারীর কারনে অনেক উগ্রপন্থী সংগঠনে অর্থ যোগান কমে যাওয়ায় ওই সংগঠনের সদস্যরা ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছে। এজন্য জেএমবি’র সদস্যরা ব্যাংক ডাকাতির মতো কাজেও নিজেদের জড়িয়েছে। এজন্য ও তারা মনগড়া ফতোয়া দিয়ে সংগঠনের সদস্যদের বিভ্রান্ত করছে। তারা মনে করছে ব্যাংক ডাকাতিতেও সওয়াব রয়েছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, তিন বছরে উগ্রপন্থিদের ৩০টি হামলার মধ্যে ২০টি হয়েছে ২০১৫ সালে। এর মধ্যে গত বছর অক্টোবরেই হামলা হয়েছে ছয়টি। ওই মাসে প্রকৌশলী খিজির খান, জাপানের নাগরিক হোশি কোনিও, ইতালির নাগরিক তাবেলা সিজার, এএসআই ইব্রাহিমকে হত্যা, খ্রিস্টান যাজক লুক সরকারকে হত্যাচেষ্টা, তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি জমায়েতে বোমা হামলা করা হয়। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ৫ অক্টোবর বাড্ডায় প্রকৌশলী খিজির খান হত্যাকান্ডে জড়িত গ্রেফতার তারিকুল ইসলাম এবং গাফফারের কাছ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের আদায় করা তথ্যে রীতিমতো বিস্মিত তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তারিকুল টাঙ্গাইলে বসবাস করে। তার সঙ্গে পরিচয় ছিলো গাফফারের। হত্যাকান্ডে আটজন অংশ নিলেও অপর ব্যক্তিদের সঙ্গে তাদের কোন পরিচয় ছিলো না। তরিকুল উগ্রপন্থীদের কাছে মিঠু নামে পরিচিত ছিলো। একই বছরের ৩০ মার্চ তেজগাঁও এলাকায় বেগুনবাড়িতে খুন হওয়া ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু হতাকান্ডে গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে আদায় করা তথ্যের সঙ্গে খিজির খান হত্যার কৌশলের মিল পান গোয়েন্দারা। বাবু হত্যার পরিকল্পনাকারী আবদুল্লাহ ওরফে আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব ওরফে বড়ভাই এবং মাওলানা জুনায়েদ আহমেদ ওরফে তাহেরকে এক বছরেও খুঁজে পায়নি কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দুজনই নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের (এবিটি) সক্রিয় সদস্য, যারা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তদন্তের চার্জশিটভুক্ত আসামি। তদন্তে এবিটি সদস্য মাসুম ওরফে ইকবাল হাদি, শরীফ ও আবরারসহ কয়েকজনের নামও উঠে এসেছে। তবে পরিচয় শনাক্ত করতে না পারায় তাদের চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করেনি পুলিশ। চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এবিটির অন্তত ১০ জন জড়িত বলে তথ্য পায় তদন্তকারীরা। তবে মাত্র তিনজনকে গ্রেফতারের পরই আদালতে চার্জশিট দাখিল করে ডিবি। ডিবি সূত্র জানায়, হত্যাকাণ্ডের এক সপ্তাহ আগে, গত বছরের ২৩ মার্চ যাত্রাবাড়ীর নয়ানগরের একটি বাসায় এবিটির সদস্যদের বৈঠক করে হত্যার চূড়ান্ত পরিকল্পনা করা হয়। বৈঠকে আব্দুল্লাহ ওরফে হাসিব, মাসুম ওরফে ইকবাল, শরীফ, তাহের ওরফে জোনায়েদ, আবরার, জিকরুল্লাহ, আরিফুল ও সাইফুল উপস্থিত ছিল। চর্জিশিটে বলা হয়, ব্লগ ও ফেসবুকে কথিত ইসলাম বিরোধী লেখালেখির কারণেই বাবুকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। চাপাতি দিয়ে মাথা ও ঘাড়ে কুপিয়ে হত্যার নির্দেশনা দেন আব্দুল্লাহ ওরফে হাসিব। বৈঠকে আটজন অংশ নিলেও বাবুকে হত্যা করতে যায় চারজন। নির্দেশনা অনুযায়ী ওৎ পেতে থাকা জিকরুল্লাহ ও আরিফুল চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে বাবুকে। আর দূরে অপেক্ষমান জুনায়েদ ওরফে তাহের দ্রুত সটকে পড়ে। সাইফুল চাপাতি নিয়ে নির্দেশনার অপেক্ষায় থাকে। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও নবগঠিত কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, অপরাধী যত বড়ই হোক না কেন ধরা তাকে পড়তেই হবে। আহমেদ রাজীব হায়দার, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, প্রকৌশলী খিজির খানসহ অনেক টার্গেট কিলিংয়ের রহস্য ইতোমধ্যেই আমরা উন্মোচন করেছি। বাকীগুলোও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী রাজীব হায়দার খুনের পর থেকে গত দুই বছরে একের পর এক হত্যা করা হয়েছে বিভিন্ন পেশার মানুষদের। ৩০ এপ্রিল টাঙ্গাইলের গোপালপুরে দর্জি নিখিল চন্দ্র জোয়ারদার নৃশংসভাবে খুন হন। এর মাত্র পাঁচ দিন আগে ২৫ এপ্রিল খুন হয়েছেন ইউএসএআইডি’র কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয়। এর ঠিক দুই দিন আগে রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এর আগের দিন গোপালগঞ্জে কুপিয়ে মেরে ফেলা হয় পরমানন্দ সাধু নামে এক পুরোহিতকে। এপ্রিল মাসেই ঢাকায় একইভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদ। একেকটি হত্যাকান্ড ঘটলেই তিনি মুক্তমনা ব্লগার কিনা, কিংবা তিনি নাস্তিক কিনা, এ ধরনের বিষয়গুলো সামনে চলে আসছে। আত্মস্বীকৃত হত্যাকারী ‘জঙ্গিগোষ্ঠী’ বরাবরই বলেছে, নাস্তিকতা এবং সেই ঘরানার লেখালেখি কিংবা তাদের ঘরানার হওয়ার কারনেই টার্গেট করা হয়েছিল নিহতদের। সর্বশেষ গত ২০ মে কুষ্টিয়ায় হোমিও প্যাথিক চিকিৎসক মীর সানাউর রহমানকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে খুন করে দুবৃত্তরা। ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান গুরুতর আহত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. সাইফুজ্জামান। এদের দু’জনই লালন ভক্ত ছিলেন। ওই দিনই ইসলামিক স্টেট (আইএস) এর নাম করে হত্যাকান্ডের দায়স্বীকার করে একটি ওয়েবসাইটে বক্তব্য চলে আসে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) নূর খান লিটন বলেন, একের পর এক এ ধরনের আক্রমণ, বিশেষ করে শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মীদের হত্যার ঘটনা মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘাতকদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না। বিচারহীনতা ও উৎকণ্ঠার সংস্কৃতি মুক্তচিন্তার মানুষদের ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতি দ্রুত এ পরিস্থিতি থেকে মুক্ত করতে হবে মানুষকে। একই সঙ্গে নিরাপত্তা-বলয় তৈরি করার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে।

সর্বশেষ খবর