বুধবার, ২৫ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিনা ওয়ারেন্ট ও সাদা পোশাকে গ্রেফতার করা যাবে না

৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনীর রায় আপিল বিভাগে বহাল

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিনা ওয়ারেন্ট ও সাদা পোশাকে গ্রেফতার করা যাবে না

বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার সংক্রান্ত ৫৪ ধারা ও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারার বিষয়ে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রেখেছে আপিল বিভাগ। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল খারিজ করে গতকাল প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এই দুই ধারা প্রয়োগের ক্ষেত্রে আপিল বিভাগ নীতিমালা তৈরি করে দেবে বলে রায়ে জানিয়েছে।

হাইকোর্টের রায়ে সরকারকে যে সব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল সেগুলো হচ্ছে— ক. আটকাদেশ (ডিটেনশন) দেওয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করতে পারবে না। খ. কাউকে গ্রেফতার করার সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে। গ. গ্রেফতারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে এর কারণ জানাতে হবে। ঘ. বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেফতার ব্যক্তির নিকটাত্মীয়কে এক ঘণ্টার  টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহক মারফত বিষয়টি জানাতে হবে। ঙ. গ্রেফতার ব্যক্তিকে তার পছন্দমতো আইনজীবী ও নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে। চ. গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের অভ্যন্তরে কাচ নির্মিত বিশেষ কক্ষে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকটাত্মীয় থাকতে পারবে। ছ. জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ওই ব্যক্তির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হবে। ট. পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে মেডিকেল বোর্ড গঠন করবেন। বোর্ড যদি বলে ওই ব্যক্তির ওপর নির্যাতন করা হয়েছে, তাহলে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং তাকে দণ্ডবিধির ৩৩০ ধারায় অভিযুক্ত করা হবে। আদালত বলেছেন, আপিল খারিজ করা হলো। ৫৪ ও ১৬৭ ধারার কিছু বিষয় সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে হাইকোর্টের রায়ের পর্যবেক্ষণে এসেছে। এ কারণে হাইকোর্ট কিছু সুপারিশ করেছেন। এ বিষয়ে কিছু সংশোধনী থাকবে। আমরা একটি নীতিমালা ঠিক করে দেব। আইনজীবীরা বলছেন, ফৌজদারি কার্যবিধির এই দুই ধারা নিয়ে হাইকোর্টের রায় বহাল থাকায় তা মানার ক্ষেত্রে সরকারের প্রতি বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে। রিটের পক্ষের অন্যতম আইনজীবী ড. কামাল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আপিল বিভাগের রায়ের ফলে হাইকোর্টের দেওয়া গাইডলাইনগুলো বহাল থাকছে। আমরা ধরে নেব সেগুলোকে বহালই রাখা হয়েছে। কিন্তু রায় দেখে আমরা এটা ব্যাখ্যা করব। নীতিগতভাবে আমরা বলতে পারব সবগুলোই বহাল আছে। এর ওপর কিছু মন্তব্য যদি তারা করেন, সেটা আমরা পূর্ণাঙ্গ রায় দেখে বলতে পারব। রিটের পক্ষের আরেক আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আপিল ডিসমিস হওয়ার পরে আমি মনে করি এই নির্দেশনাগুলো প্রতিপালন করা একটি রাষ্ট্রীয় কর্তব্য। আইনের শাসন রক্ষা করার জন্য সবচেয়ে প্রথম সারির দায়িত্ব প্রত্যাশা করি পুলিশের কাছ থেকে।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, সাদা পোশাকে কাউকে গ্রেফতার করতে হলে পুলিশের পরিচয় দেওয়া উচিত। সাদা পোশাকে নিজেদের পরিচয় না দিয়ে পৃথিবীর কোথাও এভাবে গ্রেফতার করে না। এখন দেখা যাচ্ছে, একজনকে শত্রুতাবশত গায়েব করে ফেলছে। পরিচয় দিচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক। আশা করি এটা বন্ধ হবে। তিনি বলেন, সাদা পোশাকে যারা গ্রেফতার করবেন, তাদের কাজ হবে আসামিকে অনুসরণ করা, গতিবিধি লক্ষ্য করা। তাকে গ্রেফতার করার ব্যাপারে নিশ্চয়ই পরিচয় দেওয়া উচিত। আমার মনে হয় না, নিজেদের পরিচয় না দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাউকে গ্রেফতার করতে যায়। এগুলো যারা যাচ্ছেন, তারা নিশ্চয়ই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক না। তিনি বলেন, এখন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আপিল বিভাগ যে রায় দেবেন বা যে সমস্ত নির্দেশনা দেবেন, তার আলোকে আশা করি, সরকার পদক্ষেপ নেবে। এ মামলায় রিটের পক্ষে আদালতে শুনানিতে ছিলেন ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা। গত ২২ মার্চ ও ১৭ এপ্রিল শুনানি শেষে রায়ের দিন ধার্য করা হয়। ১৯৯৮ সালের ২৩ জুলাই ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শামীম রেজা রুবেলকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করেন গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তৎকালীন সহকারী কমিশনার (এসি) আকরাম হোসেন। ওই বছরের ২৪ জুলাই মিন্টো রোডের গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে রুবেল মারা যান। এ ঘটনায় রুবেলের বাবা রমনা থানায় এসি আকরামসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ওই মামলায় ২০০২ সালে বিচারিক আদালত এসি আকরামসহ ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এরপর তৎকালীন সরকার রুবেল হত্যা তদন্তের জন্য বিচারপতি হাবিবুর রহমান খানের সমন্বয়ে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত শেষে কমিটি ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের পক্ষে কয়েকটি সুপারিশ করে। এ সুপারিশ বাস্তবায়িত না হওয়ার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) হাইকোর্টে রিট করে। ওই রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল এ ব্যাপারে কয়েক দফা নির্দেশনাসহ রায় দেয় হাইকোর্ট। রায়ে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রচলিত বিধান ছয় মাসের মধ্যে সংশোধন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি ওই ধারাগুলো সংশোধনের আগে কয়েক দফা নির্দেশনা মেনে চলার জন্য সরকারকে বলা হয়। এর বিরুদ্ধে আপিলে যায় রাষ্ট্রপক্ষ। আপিল আবেদনে বলা হয়, এ দুটি ধারা সংশ্লিষ্ট যে আইনে রয়েছে, তা যথেষ্ট ও সঠিক। এ জন্য আইন প্রণয়ন বা সংশোধনের প্রয়োজন নেই। ২০০৪ সালে আপিল বিভাগ সরকারের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করে। তবে হাইকোর্টের ওই নির্দেশনাগুলো স্থগিত করেনি। ২০১০ সালের ১১ আগস্ট মামলাটি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় আসে। তখন আদালত হাইকোর্টের নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা সরকারের কাছে জানতে চায়। কিন্তু দীর্ঘ ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও ওই নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা আদালতকে জানাতে পারেনি সরকার।

সর্বশেষ খবর