বুধবার, ২৫ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা
লেখকের অন্য চোখ

অনেক ছিপছিপে হয়ে গেছে জীবন

সমরেশ মজুমদার

অনেক ছিপছিপে হয়ে গেছে জীবন

বাল্যকালের কিছু শোনা কথা এখন আর শুনতে পাই না। তখনকার যা ছিল ‘অবশ্যই করা উচিত’ এখন তা বাতিল হয়ে

গেছে। বিজয়া দশমীর সন্ধ্যেবেলায় আমরা দলে দলে সমস্ত পাড়া ঘুরে বেড়াতাম, বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে নানান খাবার খেতাম। এখনকার ছেলেমেয়েরা এটা ভাবতেই পারে না। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যেয় লক্ষ্মীপুজোর সময় রেডিও বন্ধ রাখতে হতো, শাঁখ যখন বাজাত তখন কথা বলা নিষিদ্ধ ছিল। তালিকা তৈরি করলে দেখা যাবে আমাদের জীবন অনেক ছিপছিপে হয়ে গেছে। আগেকার মতো অত মেদবহুল নেই। এ যুগে বাঁচতে হলে স্লিম না হলে চলে? সে সময় খাওয়া-দাওয়ার ওপর সাধারণ মানুষের প্রবল আসক্তি ছিল। একটা নেমন্তন্ন পেলেই শুরু হয়ে যেত জল্পনা। কী মেন্যু হচ্ছে? আমন্ত্রিতের সংখ্যা কত? কম হলে, বাড়ির মেয়েরা রান্না করবেন। সে বাড়ির মেয়েরা কেমন রাঁধেন? বিয়ে, অন্নপ্রাশন, পৈতে তো বটেই শ্রাদ্ধের খাওয়াও মিস করত না কেউ। শেষেরটা খেতে যেত বেশ আনন্দিত চিত্তে। কারণ শ্রাদ্ধে তো কাউকে উপহার দিতে হয় না। কেন জানি না, আট-দশ বছর বয়সেই আমার মনে হয়েছিল, কেউ মারা গেলে তার শ্রাদ্ধে গিয়ে পাত পেড়ে খেতে বসা উচিত নয়। খেতে আরম্ভ করলে কি মনে শোক থাকে? ঘোষণা করে দিলাম... শ্রাদ্ধের নেমন্তন্ন আমি খাব না। বাড়ির মহিলারা গম্ভীর হলেন, সেকি! আমরা সবাই খাচ্ছি আর তুই খাবি না, এটা কী করে হয়? তোর একার জন্য কে রাঁধতে বসবে? বড্ড জ্বালাস! তোর কী হয়েছে? কেন খাবি না, বল? জবাব শুনে একজন ঠোঁট উল্টালেন... ও এই কথা? তোকে তো কেউ দিব্যি দেয়নি মাছ-মাংস খাওয়ার। প্রথমে যা দেবে তা খেয়ে উঠে আসবি!

আমি তবু গোঁ ধরে আছি দেখে একজন বয়স্ক বললেন, একটা কথা মন দিয়ে শোন। নেমন্তন্ন করে নির্বোধরা। সেই নেমন্তন্ন যারা খায় তারা সত্যিকারের বুদ্ধিমান। আমি অবাক হয়ে তাকাতে তিনি বললেন, আজ যে খাওয়াচ্ছে, তার আছে বলেই সে খাওয়াচ্ছে। তোমার নেই তাই সেই খাওয়া খেতে আপত্তি নেই। যদি তোমার থাকত আজ কি করতে তা নিয়ে ভাবা যেত! বাঃ। দশ-বারো বছর বয়সে এই প্রবাদটা শুনিনি— ‘নেই তাই খাচ্ছ, থাকলে কোথায় পেতে? পরে যখন শুনি, চমকে উঠেছিলাম। সত্যি তো নেই বলেই তো শ্রাদ্ধে খেতে যেতাম, খেতে পেতাম, থাকলে কী করতাম! ব্যাপারটা এত সহজ নয়। তখন আমাদের চাহিদা এত কম ছিল যে, অল্পতেই খুশি থাকতাম। চামড়ার বল নেই। বাতাবি লেবু দিয়েই ফুটবল খেলতাম। দুটো শার্ট দুটো প্যান্টে সারা বছর দিব্যি চলে যেত। পুজোর সময় বাটার নটিবয় শু কিনে দিতেন বাবা, তাই সারা বছর পরে চামড়া তুলে ফেলতাম। মাঝ বছরে আর একটা জুতোর জন্য বায়না করতাম না। আমি এখন জানি, বাবা চাকরিতে কত মাইনে পেতেন। তখন খবর রাখার প্রশ্নই ছিল না। তবু আমাদের মাছ-ভাতের অভাব হয়নি। রবিবারের সকালে লুচি, বেগুনভাজা হতো নিয়ম করে। আমরা সে সময় পিজা, রোল, চাউমিন নামের খাবারের কথা শুনিনি। ক্যাডবেরির বদলে চিনির তৈরি মার্বেল লজেন্সই আমাদের খুব ভালো লাগত। আমরা ভায়েরা জামা-প্যান্ট অদল-বদল করে পরতাম। কারও নিজস্ব খেলনা ছিল না। কিন্তু তার জন্য অল্পবিস্তর ঝগড়া হলেও মারপিট হতো না। তখন টিভি ছিল না।

রেডিওতে শুধু খবর হতো। সিনেমাহল ছিল জেলা শহরে। আমরা পত্রিকার মাধ্যমে খবর জানতাম। তাও যে পত্রিকা গতকাল বের হয়েছে তা আমাদের কাছে পৌঁছত আজ। অর্থাৎ আজকের বিচারে তখন সব কিছুই ‘না’-এর পর্যায়ে। আজকের কোনো বালক বা কিশোরকে বিজ্ঞান যদি সেই সময়ে নিয়ে যেতে পারত তাহলে সে বিদ্রোহ করত। কিন্তু আমাদের কোনো নালিশ ছিল না। আমরা যে কোনো কিছু থেকে বঞ্চিত হচ্ছি সে বোধই ছিল না। ছিল না বলে ‘পাচ্ছি না’ বলে আক্ষেপ ছিল না। এখনকার সময় উজাড় করে দিচ্ছে বালক-কিশোর-তরুণদের। তাদের সামনে গোটা পৃথিবী আধুনিকতম পসরা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে। দুটো শার্ট-প্যান্ট বা একটা নটিবয় শু’র কথা তারা ভাবতেই পারে না। কম্পিউটার, ল্যাপটপ বাতিল করে তারা এখন আইপডে পৌঁছে গেছে। লুচি-বেগুনভাজা বাতিল হয়ে গেছে অনেক কাল। পিজা, পাস্তা, মোমো পেরিয়ে গিয়েছে তারা। কিন্তু এত খাবার চারপাশে, তবু খেতে পারছে না মোটা হয়ে যাওয়ার ভয়ে। মিষ্টিআলু বা রেডমিট থেকে চোখ সরাতে হচ্ছে। তখন পরিবারের একজন চাকরি করত। কিন্তু বাজারদর এত কম যে সদস্যদের মাছ-ভাতের অভাব হতো না। এখন বাজারদর যত বাড়ছে তত মাইনে বাড়ছে। চারজনের পরিবারে কেউ অলস নয়। অতএব এক টাকা সের চাল যদি চল্লিশ টাকায় পৌঁছে যায় তাহলেও কোনো অসুবিধে হচ্ছে না। চাইতে এবং পেয়ে মানুষের চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা এত বেড়ে গেছে যে, এতটা যে সে চাইতে পারে তা নিজেই জানত না। আগে শীতকালে দেওঘর-শিমুলতলা-মধুপুরে বেড়াতে যেতে পারলে মন ভরে যেত। এখন গোয়া, কেরল দশবার হয়ে গেছে, দার্জিলিং পঁচিশবার। ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর তিনবার হয়ে গেল। নিউইয়র্ক গত বছর ঘোরা হয়ে গেছে। হঠাৎ বিজ্ঞাপনে চোখ গেল দুই লাখ টাকায় সুইজারল্যান্ড থেকে ফ্রান্স ১২ দিনের সফর করাচ্ছে একটা ট্রাভেল কোম্পানি। সে সঙ্গে তিন রাত ইস্তাম্বুল ফাউ। দৌড়াতে হয় না, রাত জেগে লাইন দিতে হয় না, ল্যাপটপ খুলে বোতাম টিপে ক্রেডিট কার্ডের নম্বর জানালেই টিকিট পাকা। ওমা, বলছে এর মধ্যেই ভর্তি হয়ে গেছে। মিসেসের মুখ গম্ভীর হলো। আর একটা ট্যুর কোম্পানি পাঁচ লাখ করে দিচ্ছে আর তারা রাখবে ফাইভস্টারে। একি? এও ফুল? আশ্চর্য! আমার আছে তবু আমি পাচ্ছি না কেন? তখন সেই সময়ে কিছু ছিল না কিন্তু আনন্দ ছিল। দূরে আম, কলা আর কাঁঠালের রসের সঙ্গে মুড়ি মিশিয়ে খেলে যে আনন্দ, কলাপাতায় গড়িয়ে যাওয়া ঝোলকে ভাতবন্দী করার যে আনন্দ, এখন তার মূল্য বুঝতে পারি। এখন সব আছে। সব হয়েছে। পকেটে কয়েক হাজার ডলার নিয়েও সারা দিন অভুক্ত থাকা দম্পতিকে দেখেছিলাম ইতালির মিলানে। বললেন, কদিন ফল খেয়ে বেঁচে আছি। এত বড়-ছোট রেস্টুরেন্ট কিন্তু গরু ছাড়া খাবার নেই। দুটি ভাত-ডাল আর আলুসেদ্ধ। থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম, শেষ কবে খেয়েছেন? মহিলা মাথা নেড়েছিলেন, দেশে তো আমরা তাই খাই। এর বেশি খেলে পেট জ্বলে। আলসার আছে যে! অতএব তোমার সামর্থ্য আছে কিন্তু গ্রহণ করার ক্ষমতা নেই। সেই নেই থাকার যুগে যে আনন্দে ছিলাম তা এই থাকার আমলে পেছন ফিরে দেখে সুকুমার রায়কে বাহবা দিতেই হয়। থাকতেও যে কিছু করতে পারছি না। চাহিদার শেষ কোথায়?

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর