বৃহস্পতিবার, ২৬ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা
পর্যবেক্ষণ

শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয় আসামের দিকেও তাকান

আমীর খসরু

শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয় আসামের দিকেও তাকান

ভারতের চারটি রাজ্যের সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের গুরুত্ব দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বিশেষ করে বিজেপির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৫-এর শেষের দিকে বিহার এবং দিল্লিতে বিজেপির পরাজয়ের পর ‘মোদি জোয়ার’-এ ভাটা পড়েছে বলে ভারতীয় বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেছিলেন। এমনটাও বলা হচ্ছিল, এ দুটি রাজ্যে বিজেপির পরাজয়ের অর্থ অসহিষ্ণুতার পরাজয় এবং ভারতের বিজয়। যা হোক, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্য চারটি রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফল গুরুত্বপূর্ণ। তবে বাংলাদেশের জন্য প্রতিবেশী ভারতের দুটো রাজ্য অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের নির্বাচনী ফলাফল গুরুত্বের দাবি রাখে। বাংলাদেশের মানুষ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির প্রতি বেশি আগ্রহী। সেখানে বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস দ্বিতীয় দফায় জয়লাভ করেছে বিপুলভাবে এবং মমতা ব্যানার্জি শপথ নেবেন দ্বিতীয় দফায় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে। এ সপ্তাহেই তার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হওয়ার কথা। মমতা ব্যানার্জির বিজয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা বেশ উত্ফুল্ল এবং আনন্দিত। ত্বরিতগতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এইচ মাহমুদ আলী এক বার্তায় মমতা ব্যানার্জিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। অভিনন্দন বার্তাটিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, দ্বিতীয় দফার বিজয়ে মমতার উদ্যোগে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অধিকতর উন্নয়ন হবে। ক্ষমতাসীনদের মনে এই আশাবাদের জন্ম নিয়েছে যে, তিস্তা চুক্তি মমতার দ্বিতীয় দফায় সম্পন্ন হবে। কিন্তু মমতার বিজয়ে এ দেশের কর্তাব্যক্তিদের উত্ফুল্ল এবং আনন্দিত হওয়ার তেমন কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় সমস্যাবলী সমাধানে প্রথম দফায় মমতার কর্মকাণ্ডগুলো একটু স্মরণে রাখা প্রয়োজন। তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে তার ভূমিকা কী ছিল তা সবারই জানা। ভারতে কংগ্রেস সরকারের সময়ে অর্থাৎ ২০১১-এর সেপ্টেম্বরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হয়েই যাচ্ছে— এমন উচ্চ আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছিল বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে। কিন্তু মমতা তখন আসেননি, বরং তিস্তা চুক্তির খসড়ায়ও তিনি আপত্তি উত্থাপন করেছিলেন। তিনি না আসায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এ কথাটি বলতে শুরু করল, মমতার কারণেই তিস্তা চুক্তি হয়নি এবং হচ্ছে না। এরপর তিস্তা প্রশ্নে মমতাকে রাজি করানোর জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নানাবিধ উদ্যোগ নেওয়া হলেও কোনো কাজ হয়নি। ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে এটা মনে করা হচ্ছিল, মমতা রাজি হলেই তিস্তা চুক্তি হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মমতা ব্যানার্জি যা কিছু করবেন তা ভারতের জন্য, নিজেদের স্বার্থেই। এখানে মমতা ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার একই ভূমিকা নেবে এটাই নিশ্চিত; এর ব্যতিক্রম হওয়ার কোনো কারণ নেই। এই প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করলেই তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির ভবিষ্যৎ কী তা সহজেই অনুমেয়। মমতা ব্যানার্জির বাংলাদেশনীতি শুধু তিস্তা চুক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ, এমনটা নয়। ফারাক্কা বাঁধের একটি স্লুইসগেট ভেঙে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশ যখন কিছুটা পানি পেয়েছে, তখন এর বিপক্ষে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন মমতা। ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশে কেন পানি যাচ্ছে তা নিয়ে ২০১২ সালের মার্চে মমতা ব্যানার্জি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছিলেন এবং সাক্ষাৎও করেছিলেন। এ চিঠি এবং সাক্ষাতে বাংলাদেশ যাতে পানি না পায় সে লক্ষ্যে অনতিবিলম্বে ফারাক্কার বাঁধ মেরামতের কাজ শুরু করার জন্য তিনি জোর অনুরোধও জানিয়েছিলেন। এ ছাড়াও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে মমতার ভূমিকা কী তার অনেক উদাহরণ দেওয়া সম্ভব। কাজেই দ্বিতীয় দফায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ায় মমতা ব্যানার্জির বাংলাদেশ নীতিতে আমূল পরিবর্তন আসবে এমনটা যারা বিশ্বাস করেন তাদের পুনরায় বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। বাংলাদেশের বরং বেশি মাত্রায় দৃষ্টিনিবদ্ধ করতে হবে আসামের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের দিকে। আসামে বিজেপির তেমন কোনো অস্তিত্ব ছিল না ইতিপূর্বেকার নির্বাচনগুলোতে। এবারে সেই বিজেপিই ১২৬টি আসনের মধ্যে একাই পেয়েছে ৬০টি এবং জোটগতভাবে পেয়েছে ৮৬টি। আসাম নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং, বিজেপির প্রেসিডেন্ট অমিত শাহর মতো বাঘা বাঘা সব নেতা নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় অংশ নেন। নির্বাচনের আগে তারা সেখানে বসবাসকারী মুসলমানদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবেই চিহ্নিত করে এটিকেই প্রধান নির্বাচনী ইস্যু হিসেবে গ্রহণ এবং স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আসামে বেশকিছু নির্বাচনী সভায় অংশ নিয়ে মুসলমানদের ভোটাধিকার থাকবে না— এ জাতীয় নানা বক্তব্যও দিয়েছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং স্পষ্টভাষায় বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত সিল করে দেওয়ার মাধ্যমে অনুপ্রবেশ ঠেকানো হবে বলে বক্তব্য দিয়েছিলেন। অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বের করে দেওয়া হবে বলেও তিনিসহ পুরো বিজেপি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তাদের সবার মুখে ছিল একই কথা। তবে বাংলাদেশের অনেক বিশ্লেষক এখন বলতে চাইছেন, এসব বক্তব্য নির্বাচনী বোল-চাল বা ইলেকশন রেটরিকস। কিন্তু এই বিশ্লেষকদের সঙ্গে পরিপূর্ণ একমত হওয়া বাস্তব পরিস্থিতিতেই যুক্তিযুক্ত হবে বলে মনে হয় না। আসামের বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভের পর বিজেপির নতুন মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সানোয়াল তার সরকারের অগ্রাধিকারগুলো কী হবে তার একটি রূপরেখা তুলে ধরেছেন। অগ্রাধিকারের অন্যতম প্রধান বিষয় হচ্ছে— আগামী দুই বছরের মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত সম্পূর্ণ সিল করে দেওয়া। ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’দের ব্যাপারে তার সরকার কঠোর হবে এমন কথাও রয়েছে ওই অগ্রাধিকারের তালিকায়। আর এ লক্ষ্যে আসামের নাগরিকদের জন্য তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলার কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন। কাজেই বিজেপির অনুপ্রবেশ ইস্যুটি নিছক নির্বাচনী রেটরিকস বলে মেনে নেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত তা বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে।  আসামে বিজেপির উত্থান শুধু অনুপ্রবেশকারী হঠাও বা সীমান্ত সিল করার মধ্যে সীমাবদ্ধ এমন মনে করা উচিত হবে না। কারণ, আসামে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি যে আরও বিস্তার লাভ করবে তা নিশ্চিত। আসাম বিজেপি কেন্দ্রীয় বিজেপির মতোই অসহিষ্ণুতার রাজনীতির পথে এগিয়ে যাবে বলেই ধারণা করা যায়। আর বিজেপি শুধু আসামের মধ্যেই তাদের সীমাবদ্ধ রাখবে তা নয়, ক্রমান্বয়ে ত্রিপুরাসহ সাত রাজ্যের অন্যগুলোর দিকেও তারা হাত বাড়াবে। এটা মনে রাখতে হবে, আসামে সাম্প্রদায়িক ও অসহিষ্ণু রাজনীতির বিস্তার এবং উত্থানের নানাবিধ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের ওপরও পড়বে। বাংলাদেশের বিদ্যমান সাম্প্রদায়িক ও অসহিষ্ণুতার রাজনীতিতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। এই রাজনীতিতে যারা বিশ্বাসী তারা এমন একটি পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে— এটাই স্বাভাবিক। কাজেই শুধু পশ্চিমবঙ্গের দিকে না তাকিয়ে থেকে আসামের দিকেও দৃষ্টিনিবদ্ধ করা খুবই জরুরি।

লেখক : সম্পাদক, আমাদের বুধবার ডটকম

সর্বশেষ খবর