শিরোনাম
শুক্রবার, ২৭ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

ইয়াবায় পুড়ছে ৪৮ হাজার কোটি টাকা

আসক্তির সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৩০ লাখ জড়াচ্ছে ব্যবসায়ী চাকরিজীবীরাও

মির্জা মেহেদী তমাল

ইয়াবায় পুড়ছে ৪৮ হাজার কোটি টাকা

দেশে সর্বপ্রথম ইয়াবা ঢোকে ২০০১ সালে। ইয়াবার সেই চালান টেকনাফে নিয়ে আসেন মিয়ানমারের নাগরিক পিচ্চি আনোয়ার। দেশের একশ্রেণির উচ্চাভিলাষী সেবনকারীর কাছে তখন ইয়াবা মাদক হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে ১৫ বছর। হালে সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে এ মাদক। শহর-বন্দর-গ্রাম— সবখানেই এখন হাত বাড়ালেই মিলছে মরণনেশা ইয়াবা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের হিসাবমতে, বাংলাদেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ৬০ লাখ। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই এখন ইয়াবায় আসক্ত। ইয়াবার পেছনে সেবনকারীরা দিনে খরচ করছেন প্রায় ১৩৫ কোটি টাকা। বছরে এ অঙ্ক দাঁড়ায় ৪৮ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। প্রতি বছর ইয়াবার আগুনে ধোঁয়া হচ্ছে এ বিপুল অঙ্কের টাকা। আর এ টাকা জোগাড় করতে ইয়াবা সেবনকারীরা সহিংস হয়ে ওঠেন। খুন-খারাবি থেকে শুরু করে ছিনতাই, ডাকাতি, চুরির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী আর তরুণ-তরুণী শুধু নয়; ছোট-বড় ব্যবসায়ী, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীর একটি অংশ এখন ইয়াবায় আসক্ত। ১৫ থেকে ৫০ বছর বয়সী নারী-পুরুষ এখন এ মাদক সেবন করছে। তবে ১৬ থেকে ৩০ বছর বয়সী মাদকসেবীর সংখ্যাই বেশি। ভয়ঙ্কর মাদক ইয়াবার থাবায় বিপন্ন হয়ে পড়েছে বহু পরিবারের সন্তানের জীবন। নেশায় আসক্ত হয়ে পড়া ছেলেমেয়েদের মায়ের কান্নাও থামছে না। অসহায় এ মায়েদের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঝেমধ্যে ইয়াবার চালান আটক করলেও বন্ধ করা যাচ্ছে না এ বাণিজ্য। মাদক সিন্ডিকেটের জাল সারা দেশে ছড়ানো। বিগত এক বছরে সারা দেশে ১ কোটিরও বেশি ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, মাদক ব্যবহারের মাত্রা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে মাদক উদ্ধারের হিসাব একমাত্র নির্দেশক নয়। তবু বাংলাদেশে মাদক ব্যবহারের ধারণা নেওয়া হয় উদ্ধারের হিসাব থেকেই। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, যে পরিমাণ ইয়াবা ধরা পড়ে, তার কয়েকশ গুণ বেশি ইয়াবা এ দেশে ব্যবহূত হচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, পুলিশ ও র‌্যাব সূত্র জানায়, আশির দশকের শুরুতে ‘ইউনাইটেড ওয়া স্টেইট আর্মি’ নামের একটি সংগঠন মিয়ানমারে কারখানা স্থাপন করে ইয়াবা তৈরি শুরু করে। ওই সময় বাংলাদেশে ইয়াবার তেমন পরিচিতি ছিল না। পিচ্চি আনোয়ারের পর টেকনাফের হাজী বশরের ছেলে বহুল আলোচিত একটেল রমজান ও বার্মাইয়া শুক্কুর নামে দুজন হুন্ডি ব্যবসায়ী ২০০১ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশে ইয়াবা আনতে শুরু করেন। তাদের হাত ধরে সম্প্রসারিত হয় দেশময় ইয়াবা পাচার। ব্যাপক চাহিদার কথা বিবেচনা করে সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের মংডু শহর ও তার আশপাশে এখন সাতটি কারখানায় তৈরি হচ্ছে ইয়াবা। মিয়ানমার ও বাংলাদেশি মাদক ব্যবসায়ীরা এ সাতটি কারখানা পরিচালনা করছেন। টেকনাফে এখন ঘরে ঘরে ইয়াবা ব্যবসায়ী।

সূত্র জানায়, সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে প্রেরিত এক প্রতিবেদনে মিয়ানমারের মংডু শহরের এসব কারখানার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ইয়াবার এসব কারখানায় পাঁচ প্রকার ইয়াবা বর্তমানে তৈরি হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে— এস ওয়াই, জিপি, এন ওয়াই, ডব্লিউ ওয়াই ও গোল্ডেন। প্রতিদিন ১ কোটিরও বেশি ইয়াবা আসছে বাংলাদেশে। সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে ১০৩ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯০ জন দেশি ও ১৩ জন মিয়ানমারের অধিবাসী। তবে অন্য সূত্রগুলো বলছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), পুলিশ ও র‌্যাবের তত্পরতার বাইরে বড় মাপের আরও দুই শতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ী সক্রিয় রয়েছেন। অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের এক এমপি ও তার দুই ভাইয়ের নাম রয়েছে। তিনজনই শীর্ষ ব্যবসায়ী হিসেবে তালিকাভুক্ত। ক্ষমতার দাপটে এ পরিবারের সদস্যদের মতোই আরও অনেক ইয়াবা ব্যবসায়ী তালিকাভুক্ত হয়েও ধরাছোঁয়ার বাইরে। দায়িত্বশীল সূত্রগুলোর তথ্যমতে, ৯০ শতাংশ ইয়াবা ব্যবসায়ী গ্রেফতার এড়িয়ে চলছেন। ১০ শতাংশ গ্রেফতার হলেও তাদের অনেকেই জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার একই অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, মানবদেহের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর নেশাদ্রব্যের মধ্যে ইয়াবা অন্যতম। ইয়াবা মানে ক্রেজি মেডিসিন বা পাগলা ওষুধ। মেথ্যাম ফিটামিন, উত্তেজক পদার্থ ক্যাফিনের সঙ্গে হেরোইন মিশিয়ে তৈরি করা হয় ইয়াবা। এ নেশাদ্রব্য হেরোইনের চেয়ে ভয়াবহ বলে মনে করেন তারা। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরাধীরা ক্রমে সহিংস হয়ে উঠছে ইয়াবার প্রভাবেই। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন) সৈয়দ তৌফিক উদ্দিন আহমেদ বলেন, মাদক পাচার বন্ধে ভারতের সঙ্গে চুক্তির পর ফেনসিডিল পাচার কমে গেছে। ভারত সরকার বাংলাদেশের সীমান্তে অবৈধ ফেনসিডিল কারখানাগুলো উচ্ছেদ করেছে। এখন কূটনৈতিক চ্যানেলে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর এর মধ্য দিয়ে ইয়াবা পাচার কমে যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানে এখন বড় ভূমিকা রাখছে র‌্যাব। র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেন, মাদকের বিষয়ে জিরো টলারেন্স অবস্থান নিয়েছে র‌্যাব। প্রায় প্রতিদিনই অভিযান চালানো হচ্ছে।

ইয়াবা রুট : একটি মাত্র রুট দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে ঢুকছে ইয়াবা। এর পরও বন্ধ করা যাচ্ছে না ইয়াবা পাচার। অল্প সময়ে বড়লোক হওয়ার নেশায় অনেকেই জড়িয়ে পড়ছেন ইয়াবা ব্যবসায়। সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় অন্যান্য মাদকের চেয়ে ইয়াবার কদর এখন সবচেয়ে বেশি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, শত চেষ্টায়ও ইয়াবা চালানের রুটটি বন্ধ করা যাচ্ছে না। মিয়ানমার থেকে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারকেন্দ্রিক রুটেই দেশে আসে ইয়াবা।

গত এক বছরে এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন প্রায় ১ কোটি পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে; যার মধ্যে ৭০ লাখ পিস উদ্ধার করা হয়েছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার থেকে। এ ছাড়া পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সদস্যরা নিয়মিত ইয়াবা উদ্ধার করছেন।

সূত্রগুলো বলছে, থাইল্যান্ড থেকে বিস্তার শুরু হলেও মিয়ানমার থেকে নাফ নদ পার হয়ে কক্সবাজারের টেকনাফ দিয়ে চলে আসছে ইয়াবার চালান। এর বাইরে কক্সবাজারের উখিয়ার ঘুন্দুম সীমান্ত দিয়েও ঢুকছে। কক্সবাজার থেকে রাজধানীতে ইয়াবা ছড়াচ্ছে এখানকার নয়টি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। এদের রয়েছে সাব-গ্রুপ। কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকার একশ্রেণির মধ্য ও নিম্নবিত্ত বেকার যুবকের ৮ বা ১০ জনের দল বাসে বা ট্রেনে ঢাকায় আসে। তারাই মূলত এর বাহক। ছোট আকারের এ ট্যাবলেট বহনের কায়দাও অভিনব। শার্টের কলারে, মুঠোফোনের ভিতর, প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরে পায়ুপথে ঢুকিয়ে আনার রেকর্ডও রয়েছে। ট্রেনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসার পথে টঙ্গী স্টেশনে নেমে যায় তারা। বর্তমানে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন ইয়াবার চালান খালাসের অন্যতম স্থান হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। ওখান থেকে মুঠোফোনে যোগাযোগের মাধ্যমে জোনভিত্তিক নেতার কাছে ইয়াবা পৌঁছে দেওয়া হয়। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।

হাত বাড়ালেই : অনুসন্ধানে জানা গেছে, ‘ক্রেজি ড্রাগ’ খ্যাত এ বড়িটি পেতে এখন আর নির্দিষ্ট এলাকা বা গণ্ডিতে যেতে হয় না। হাত বাড়ালেই এখন রাজধানীর যে কোনো পাড়া, মহল্লা, অলিগলিতেই পাওয়া যাচ্ছে হরেক রঙের নেশার এ বড়িটি। শুধু তাই নয়, রাজধানী ও বড় বড় শহর ছাড়িয়ে ইয়াবা পৌঁছে গেছে অজপাড়াগাঁয়েও।

সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একশ্রেণির সদস্য ইয়াবার খুচরা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন। তারা বড় চালান আটকের জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষায় থাকেন। কিন্তু খুচরা মার্কেট বন্ধ করতে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখেন না। যে কারণে কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না ইয়াবা নামের এ মরণনেশা।

সর্বশেষ খবর