শুক্রবার, ২৭ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা
পর্যবেক্ষণ

সম্প্রচার নীতিমালা নাকি পরাধীনতার কণ্টকমালা?

রোবায়েত ফেরদৌস

সম্প্রচার নীতিমালা নাকি পরাধীনতার কণ্টকমালা?

বাংলাদেশের চারদিকে পৃথিবী ঘোরে আর দুনিয়ার সবাই নিয়ম করে বিটিভি দেখে আর বেতার শোনে—গেল কয়েক দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারের সম্প্রচার নিয়ে এ দেশের রাজনীতিবিদ আর আমলাদের কর্মকাণ্ড দেখে আমাদের এই-ই মনে হয়। এবার এ দুই গোষ্ঠী জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা তৈরির জন্য কাছা মেরে মাঠে নেমেছে।

সম্প্রচার নীতিমালার পটভূমিতে বলা হয়েছে : সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে সকল নাগরিকের চিন্তা ও বিবেক, বাক এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। এরপরই এই নীতিমালায় কী কী প্রচার করতে হবে তার একটি বিশদ বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। বিষয়টি সাংঘর্ষিক হয়ে গেল না? গণমাধ্যম যদি স্বাধীন হয় তবে গণমাধ্যম কী প্রচার করবে আর কী করবে না, তা তো গণমাধ্যমের ব্যাপার; কিন্তু সরকার যদি নির্ধারণ করে দেয় কী প্রচার হবে, তা কি আর স্বাধীনতা থাকল? পৃথিবীর সব সরকার মিথ্যা বলে এবং পৃথিবীর সব সরকার জনগণের কাছে তথ্য লুকাতে চায়। গণমাধ্যমের কাজ সেই মিথ্যার জায়গায় সত্য প্রতিষ্ঠা করা আর লুক্কায়িত তথ্য টেনে বের করে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেওয়া। সব সরকারই তাই মুক্তপ্রান্ত কথা বলা আর সমালোচনাকে ভয় পায়। বাংলাদেশের সংসদে দেখি, বিরোধী দল সরকারের কথায় প্রতিদিন উঠবোস করছে। সে ক্ষেত্রে সরকারের সমালোচনা করার একমাত্র সুযোগ ছিল গণমাধ্যমের। এ নীতিমালার মাধ্যমে তাও বন্ধ হয় কিনা সেই সংশয় একশ ভাগ। বর্তমান সরকার প্রায়ই বলে, তারা গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। বিএনপি সরকারও এ কথা বহুবার বলেছে। এমনকি বিএনপি এও দাবি করে, বিএনপি সংবাদমাধ্যমকে যেটুকু স্বাধীনতা দিয়েছে, সেই পরিমাণ স্বাধীনতা কোনো সরকারই দেয়নি; তারা আরও দাবি করে, আওয়ামী লীগ বাকশাল কায়েম করে মাত্র চারটি সংবাদপত্র ছাড়া সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়ে সংবাদমাধ্যমের যে স্বাধীনতা হরণ করেছিল, বিএনপি সরকার সেই স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়েছে। এই কৃতিত্ব তারা সব সময়ই নিতে চায়।

এ দুই রাজনৈতিক দলের দাবির তাত্পর্য আসলে কী? এ সরকারের আমলে যে তথ্যপ্রযুক্তি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, তা এক ভয়ঙ্কর কালাকানুন। এ আইন অনলাইনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর এক মারাত্মক খড়্গ হিসেবে ঝুলে রয়েছে। অনলাইনভিত্তিক সংবাদমাধ্যমে লেখালেখি, ছবি, অডিও, ভিডিও ইত্যাদি প্রকাশের ক্ষেত্রে সরকার নিজের ইচ্ছামতো এ আইনের ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে যে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারে। হতাশার বিষয় হলো, আমরা এখন যে কথাটা কাগজে লিখতে পারছি তা যখন আবার অনলাইনে লেখা হবে তখন তা অপরাধ বলে গণ্য হবে। এটা আইনের অসঙ্গতি; আর এ অসঙ্গতিতে কখনই আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ হতে পারে না। ইতিমধ্যে আমরা এর অপব্যবহার লক্ষ্য করছি।

তথ্যপ্রযুক্তি আইন আর জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা সরকার কেন করল, কার জন্য করল? তথ্য অধিকার আইন ও সংবিধানের সঙ্গে বাকি দুটি সাংঘর্ষিক। সম্প্রচার নীতিমালায় বলা হয়েছে, কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের অনুকূলে এমন ধরনের প্রচারণা, যা বাংলাদেশ ও সংশ্লিষ্ট দেশের মধ্যে বিরোধের কোনো বিষয়কে প্রভাবিত করতে পারে, এমন দৃশ্য ও বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। গণমাধ্যম কী করে বুঝবে অমুক রাষ্ট্রটি আমাদের বন্ধু অমুক আমাদের শত্রু। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি তাদের কোনো তালিকা দিয়েছে? আর এটা দেওয়ার ক্ষমতা কি আছে মন্ত্রণালয়ের? নীতিমালা অনুযায়ী বিচারিক ক্ষমতা আছে এমন সরকারি কর্মকর্তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়, এমন ছবি ও বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। জেলা প্রশাসকদের বিচারিক ক্ষমতা আছে। তাই বলে তাদের আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ড প্রচার করা যাবে না! নীতিমালায় সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি কটাক্ষ বা অবমাননাকর দৃশ্য বা বক্তব্য প্রচার না করার কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ওই প্রতিষ্ঠানের কোনো সদস্য যদি বেআইনি কিছু করে, সেটিকেও প্রতিষ্ঠানের প্রতি কটাক্ষ বলে চালিয়ে দেওয়ার সুযোগ থেকে যায়। ব্যক্তি আর প্রতিষ্ঠান যে আলাদা— সরকার কি সেই ভেদরেখা মুছে দিতে চায়?

‘আলোচনা অনুষ্ঠানে কোনো ধরনের বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য বা উপাত্ত দেওয়া পরিহার করতে হবে।’ অসত্য তথ্য তো অসত্যই। তা অবশ্যই পরিহার করতে হবে। কিন্তু ‘বিভ্রান্তিকর তথ্য’ কোনটিকে বলা যাবে, তা কার কাছে বিভ্রান্তিকর মনে হবে, এটা কে ঠিক করবে? যিনি বিষয়টি সম্পর্কে উল্টো জানেন তার কাছে তো তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হতেই পারে। বাংলাদেশের ইতিহাস, রাষ্ট্র ও রাজনীতি নিয়ে এখনো অনেক অমীমাংসিত এবং কখনো কখনো অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক আছে, সে ক্ষেত্রে এর ফয়সালা কী করে হবে? কী ধরনের তথ্য প্রচার করলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়, এটা নির্ধারণ করবে কে? এটা তো যেমন ইচ্ছা তেমন করে ব্যাখ্যা করা যায়। সরকারের বিশেষ বাহিনী নিয়ে কথা বলা যাবে না, তাহলে আমার প্রশ্ন— এ রকম নীতিমালা থাকলে কি ১০ ট্রাক অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা প্রচার করা যেত? ওই ঘটনায় তো এনএসআই ও ডিজিএফআইর কর্মকর্তাদের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা ছিল। আবার ধরুন, ২০০৫ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ওপর যে গ্রেনেড হামলা হয়েছিল তা কি প্রচার করা যেত? এ ঘটনায় তো পুলিশের তিন সাবেক মহাপরিদর্শক, এনএসআইর দুজন সাবেক প্রধান ও সিআইডির তিন সাবেক কর্মকর্তাসহ সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার যুক্ততার প্রমাণ মিলেছে; কিংবা ধরুন, নারায়ণগঞ্জে সাত ব্যক্তির অপহরণ ও খুনের ঘটনার ক্ষেত্রে কী ঘটত? সংবাদ প্রকাশের সুযোগ কি ছিল? ২০১৪ সালের ৮ আগস্ট সিলেটে এক আলোচনা সভায় প্রয়াত সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে বলেছিলেন ‘এরা সব খবিশ, চরিত্রহীন! স্বাধীন কমিশন হলে পরে দেখে নেব, তোমরা সাংবাদিকরা কতটুকু যেতে পারো!’ তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন সম্প্রচার নীতিমালা গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের জন্য নয়, বরং এর প্রতিটি ধারা গণমাধ্যমের জন্য কল্যাণকর ও সম্প্রচারে সহায়ক (প্রথম আলো, ১২ আগস্ট ২০১৪)। এই মন্ত্রীর মুখেই আবার শোনা গেছে, নীতিমালার কথা শুনলেই যারা হৈচৈ করেন, তারা সব ‘স্বৈরাচারের দালাল’। কাথা দুটি বিপরীতমুখী। সরকার চাইলে এ নীতিমালাকে দুই দিকেই ব্যবহার করতে পারে। কোনটি করছে বা করবে সাধারণ মানুষ তা বুঝতে পারছে ঠিকই। অতএব, সাধু সাবধান! এই নীতিমালার আলোকে একটি স্বাধীন ‘সম্প্রচার কমিশন’ গঠন করা হবে। তবে কত দিনের মধ্যে কমিশন গঠিত হবে, তাও নির্দিষ্ট করা নেই। কমিশন কি সত্যিই স্বাধীন হবে? নাকি অন্যসব কমিশনের মতো সরকারের বশংবদ আর স্তাবকদের দিয়েই সম্প্রচার কমিশন গঠন করা হবে? সেটাও বড় প্রশ্ন বইকি।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

সর্বশেষ খবর