শনিবার, ২৮ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

এলাকার নিয়ন্ত্রণে ব্যাস্ত এমপিরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

এলাকার নিয়ন্ত্রণে ব্যাস্ত এমপিরা

দলের এক ত্যাগী নেতাকে হত্যার অভিযোগে টাঙ্গাইলের সরকারদলীয় এমপি আমানুর রহমান রানা এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। পলাতক রয়েছেন তার অন্য ভাইয়েরাও। এক সময় টাঙ্গাইল আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রক ছিলেন রানা পরিবার। টাঙ্গাইলের টেন্ডার ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ করতেন তারা। কুমিল্লার মনোহরগঞ্জের সরষপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ নেতা খুন করাসহ ১৩ মামলার আসামি বিএনপির ক্যাডারদেরকে রহস্যজনক কারণে ঠাঁই দেওয়া হয়েছে যুবলীগে। সরকারি দলে যোগদানের পর থেকেই ওই ক্যাডারদের অত্যাচারে এলাকাছাড়া হন ত্যাগী নেতা-কর্মীরা। গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর অবশ্য ওই ক্যাডারদের আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। অথচ প্রভাবশালীদের কারণে থানা পুলিশ কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি। 

সারা দেশের চালচিত্র প্রায় একই রকম। প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিরা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন স্থানীয় সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের। অনেকেই দাপুটে অবস্থান এভাবে তৈরি করেছেন যেন, সরকারি দল করলে ‘সাত খুন মাফ’। বিশিষ্টজনদের মতে, আইনের শাসন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ না করলে সারা দেশে খুন ও সন্ত্রাস বাড়বে। এক্ষেত্রে সরকারি দল হবে সরকারি দলের প্রতিপক্ষ। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে পৌরসভা ও ইউপি নির্বাচনে। ক্রমেই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে সমাজ ব্যবস্থা। বিব্রত হচ্ছে খোদ সরকার ও আওয়ামী লীগ।

এ প্রসঙ্গে গতকাল সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স প্রধানমন্ত্রী। সেটা দলের মন্ত্রী-এমপি যেই হোন না কেন। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন এমপির নানা অনিয়মের প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কাছে এসেছে। তিনি এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে। যেখানে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে, তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অন্যায়কারীরা কেউই পার পাবেন না।’ সূত্রমতে, বিগত ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের পর প্রভাবশালী এসব এমপি-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। প্রায় শতাধিক সরকারদলীয় এমপির অপকর্মের সারসংক্ষেপ দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টেবিলেও উত্থাপন করা হয়েছে। এ নিয়ে তিনিও চরম ক্ষুব্ধ। অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও শুরু করেছেন। আগামী কাউন্সিলেও অনেক বিতর্কিত নেতার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবেন। ত্যাগীদের যোগ্য পদে এনে ভবিষ্যতে দলের প্রতীকও তাদের হাতে তুলে দেবেন। এ কারণেই কাউন্সিলকে ঘিরে উৎকণ্ঠায় দুর্নীতিবাজসহ এই প্রভাবশালীরা।  স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, আধিপত্য বাড়াতে সম্প্রতি বিএনপি-জামায়াত ক্যাডারদেরও দলে বেড়াচ্ছেন ওইসব প্রভাবশালী। নানা অভিযোগ থাকা এসব ক্যাডারকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা পছন্দ করছেন না। কিন্তু তাদের দলে ভেড়াতে নেওয়া হচ্ছে লাখ থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত। এমনকি পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও বেশ কিছু বিএনপি-জামায়াত ক্যাডারকে দলীয় মনোনয়ন নৌকা প্রতীক দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে এলাকায় সমালোচনার ঝড় বইলেও পাত্তাই দেননি ওইসব এমপি। যুদ্ধাপরাধীর সন্তান ও রাজাকারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকার পরও চলতি ইউপি নির্বাচনে অন্তত ৩০ নৌকা প্রতীকে প্রার্থী হয়েছেন। এদের পেছনে লেনদেন হয়েছে কোটি টাকা পর্যন্ত। তাদের নেপথ্যে ছিলেন সরকারদলীয় এমপি-মন্ত্রীরা। আওয়ামী লীগ সমর্থক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সরকারের দুই মেয়াদে টানা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা এমপিদের একটি অংশ ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে নিজ এলাকায় পরিণত হয়েছেন ‘মুকুটবিহীন সম্রাটে’। জনকল্যাণমুখী পদক্ষেপ গ্রহণের পরিবর্তে এলাকায় কায়েম করেছেন ত্রাসের রাজত্ব। বিতর্কিত এসব এমপির কর্মকাণ্ডে একদিকে যেমন সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস, অন্যদিকে বারবারই বেকায়দায় পড়তে হয়েছে সরকারকে। এমপি ও তাদের আশীর্বাদপুষ্টদের এসব অপকর্ম দলের নীতিনির্ধারকরাও ভালো চোখে দেখছেন না। এসব নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদীয় দলের একাধিক সভায় বিতর্কিত কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কড়া ভাষায় সতর্ক করেছেন। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুরে সরকারদলীয় দুই এমপির সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ ও  গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। ঢাকা-১৪ আসনের এমপি আসলামুল হক আসলাম ও সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি সাবিনা আক্তার তুহিনের সমর্থকদের মধ্যে এ সংঘর্ষ হয়। এতে পুলিশের তিন সদস্যসহ অন্তত ৩০ জন আহত হন। মিরপুর-১ এর মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্সের সামনে এ ঘটনা ঘটে। জামায়াতের হরতালবিরোধী মিছিলকে ঘিরে এ ঘটনার সূত্রপাত হলেও কার্যত স্থানীয় কমিটি নিয়ে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করেই দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়ায়। শ্যামপুর-কদমতলী এলাকার সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি আওয়ামী লীগের সানজিদা খানম। ওই এলাকার নির্বাচিত এমপি জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা। শিল্প এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েই এই দুই এমপির অনুসারীরা মাঝে-মধ্যেই প্রকাশ্য বিরোধে লিপ্ত হয়। ওই শিল্প এলাকা থেকে মাসে কোটি টাকা মাসোয়ারা পান প্রভাবশালীরা। জানা যায়, সদ্য ঘোষিত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি গঠনের পর থেকে সানজিদা গ্রুপের লোকজনকে শীর্ষ পদে রাখা হয়নি। ফলে ক্ষুব্ধ হন সানজিদা খানম। এতদিন কদমতলী থানার ৫২ নম্বর ও শ্যামপুর আওয়ামী লীগ অফিস দখল করে এমপির অফিসের সাইনবোর্ড লাগায় সানজিদা গ্রুপের লোকজন। এরপর স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ হয়ে কদমতলী থানা অফিস দখলমুক্ত করতে গেলে সানজিদা গ্রুপের সঙ্গে মারামারি হয়। অভিযোগ রয়েছে, কদমতলীর অফিসে এখনো সানজিদার সাইনবোর্ড লাগানো রয়েছে।  আওয়ামী লীগের দুই মেয়াদেই সবচেয়ে আলোচনায় রয়েছেন কক্সবাজার-৪ আসন থেকে নির্বাচিত এমপি আবদুর রহমান বদি। অবৈধ সম্পদ উপার্জনের অভিযোগে তার ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ নিয়ে তাকে জেলের গানিও টানতে হয়। ইয়াবার গডফাদারের পর এবার তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে মানব পাচারের। সন্ত্রাসী তত্পরতা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা, চোরাচালান, জমি দখল— প্রায় সব অভিযোগের আঙ্গুল তার দিকে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ প্রশাসনের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা তার ভয়ে তটস্থ থাকেন সব সময়। একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছেন সরকারদলীয় এই সংসদ সদস্য। স্থানীয় সাংবাদিকরাও রক্ষা পাননি তার হাত থেকে। যশোর-৪ এর সংসদ সদস্য রণজিত কুমার রায়ও বসে নেই। তার বিরুদ্ধেও নিজ দলের নেতা হত্যাকাণ্ডে মদদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। পাবনা-৫ আসনের এমপি গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্সের বিরুদ্ধেও অভিযোগের শেষ নেই। সরকারি অফিসে লোক নিয়োগ, টেন্ডার-বাণিজ্য, সাংবাদিকদের ওপর হামলা, অ্যাডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি নিয়ে অধ্যক্ষকে মারধর ও ভর্তি বন্ধ, শহীদ বুলবুল কলেজের অধ্যক্ষকে মারধর ও পাবনা সিভিল সার্জনকে জোর করে অফিস  থেকে তুলে নিয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন ঘটনায় মদদ  দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। নোয়াখালীর হাতিয়ায় চলছে এমপি মোহাম্মদ আলীর শাসন। সরকারি প্রশাসনের পাশাপাশি দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় এখন চলছে বেসরকারিভাবে পরিচালিত কমান্ডোর মাধ্যমে। স্থানীয় লোকজন জানান, সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলী উপজেলাকে কয়েকটি কমান্ড সেক্টরে ভাগ করেছেন। কাগজে-কলমে না হলেও মৌখিক ভাগাভাগিতেই নিজ নিজ সেক্টরে কাজ করে কমান্ডাররা। জাতীয় ও উপজেলা নির্বাচনে যারা প্রতিপক্ষের হয়ে কাজ করেছেন তাদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়াই এদের প্রধান কাজ। চরে শালিস-বিচার, অন্যায়-অত্যাচারের মাধ্যমে বিত্তের পাহাড় গড়ে তুলছে এই কমান্ড। চরের চারদিকে মেঘনা নদীও শাসন করে এরা। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তার পছন্দের প্রার্থী দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ায় বিদ্রোহী প্রার্থী শুধু দাঁড়ই করাননি, দল সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করায় অর্ধশত মানুষকে শারীরিক নির্যাতন করেছেন তিনি। খুলনার আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা জানান, জেলার কয়রা ও পাইকগাছার এমপি অ্যাডভোকেট শেখ নুরুল হক তার দলের নেতা-কর্মীর কোনো খোঁজখবর রাখেন না। নিজের আলাদা বলয়ে, নিজের মতো করে সাম্রাজ্য তৈরি করে নিয়েছেন। নির্বাচনী এলাকার শত শত বিঘা ঘের দখল করেছেন। ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁওয়ের এমপি ফাহমি গোলন্দাজ তার ইচ্ছার বাইরে কিছু করতে দেন না নির্বাচনী এলাকায়। দলীয় নেতা-কর্মীরা একরকম জিম্মি এ এমপির কাছে। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিশদ প্রতিবেদন রয়েছে বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন। নিজের অবস্থান পাকা করার জন্য চট্টগ্রামের বাঁশখালীর এমপি মোস্তাফিজুর রহমান নিজেই নিয়েছেন উপজেলার সব দায়িত্ব। তার ইচ্ছামতো চলে সেখানকার আওয়ামী লীগ। ছাত্রলীগের কমিটি রয়েছে তিনটি। এমপির কমিটির সভাপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে শিবির সম্পৃক্ততার। দক্ষিণ জেলায়ও ছাত্রলীগের কমিটি নেই এক বছর তিন মাস ধরে। জেলার পটিয়া, সাতকানিয়ার অবস্থাও বেহাল। এমপি খোঁজ নেন না আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের। ত্যাগী নেতা-কর্মীরা বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। কিছু জেলার সুযোগসন্ধানীরা দলে ঢুকছেন এমপির বদান্যতায়। নাটোর সদর আসনের এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুল। তিনিই নাটোরের সব হর্তাকর্তা। তার ইশারায় সব কিছু হয়। দলীয় নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে বিএনপি-জামায়াত ঘেঁষা লোকজন তার চারপাশে। ঠাকুরগাঁও-২ আসনের সংসদ সদস্য দবিরুল ইসলামের প্রভাব-প্রতিপত্তিকেও হার মানিয়েছেন তারই ছেলে মাজহারুল ইসলাম সুজন। বাপ-বেটার বিরুদ্ধে নির্যাতন-নিপীড়ন ও সংখ্যালঘুদের জমি দখলের এন্তার অভিযোগ রয়েছে।

সর্বশেষ খবর