রবিবার, ২৯ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

কার ভুলে সর্বনাশ

আকতারুজ্জামান রুনকি

কার ভুলে সর্বনাশ

বরিশালের উদয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল সর্বজিৎ ঘোষ হূদয় (১৭)। ১১ মে প্রকাশ করা ফলাফলে হিন্দুধর্মে অকৃতকার্য হয় সে। চার বিষয়ে জিপিএ-৫ পাওয়া সর্বজিৎ হিন্দুধর্মে ফেল করার বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। ওই দিন দুপুরেই নগরীর সাততলা ভবন থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে এই শিক্ষার্থী। এ ঘটনায় টনক নড়ে বরিশাল শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষের। ফলাফল পুনর্মূল্যায়ন করে নতুন ফল ঘোষণা করে বোর্ড। পুনর্মূল্যায়নে হিন্দুধর্মে জিপিএ-৫ পায় সর্বজিৎ। কিন্তু এ ফলপ্রাপ্তিতে আনন্দের পরিবর্তে ওই পরিবারে আরও বিষাদের ছায়া নেমে আসে। এ ফল শোনার পর সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন সর্বজিতের মা শিলা ঘোষ।

নীলফামারী সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র আশিকুর রহমান (এসএসসি রোল-১৮১৬৩৩)। সবগুলো বিষয়ে ‘এ’ প্লাস পেলেও জীববিজ্ঞানে তাকে অকৃতকার্য দেখানো হয়েছে। এটি অসম্ভব বলছেন তার বাবা রামগঞ্জ দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মনিবুর রহমান। বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে তিনি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেন, এটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। কোথাও বড় ধরনের গলদ হয়েছে। এমন খামখেয়ালিপনা মেনে নেওয়া যায় না। দুশ্চিন্তায় আশিক খাওয়াদাওয়া ছেড়ে পাগলপ্রায়। যে কোনো সময় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তার মা লায়লা আঞ্জুমান বানু। শুধু এই দুই শিক্ষার্থীই নয়, প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থীরাও এমন অঘটনের শিকার হচ্ছে। প্রতিবছরই শিক্ষক, শিক্ষা বোর্ড বা দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা, উদাসীনতা, কারিগরি ত্রুটিসহ নানাভাবে স্বেচ্ছাচারিতার বলি হচ্ছে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা। নিশ্চিত পাস করবে এমন শিক্ষার্থীরাও আসছে ফেলের তালিকায়। অপ্রত্যাশিত এ ফলাফল মেনে নিতে না পেরে অনেকেই আত্মহত্যা করছে। অনেক মেধাবী তার শিক্ষাজীবনের ইতি টানছে সেখানেই। কিন্তু এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে না। কোনো ঘটনারই সুষ্ঠু তদন্ত হচ্ছে না। কার ভুলে এমন সর্বনাশ ঘটছে তা জানতে পারছেন না ছাত্র-ছাত্রী বা তার অভিভাবকরা। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভালো পরীক্ষা দেওয়ার পর শিক্ষার্থীরা যদি সে অনুপাতে ফল না পায় তবে সেটি দুঃখজনক। এ কারণে প্রতিবছরই বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। ফেল করার পর আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীর ফল পুনর্মূল্যায়নে জিপিও-৫ পাওয়া আরও উদ্বেগজনক। এ ক্ষেত্রে বলতেই হবে যে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ড পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে তদারক করছে না। এর দায় শিক্ষা বোর্ডের। এ ইমেরিটাস অধ্যাপক অভিযোগ করে বলেন, বোর্ডের দায়িত্বপ্রাপ্তরা মনে হয় মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে চিন্তিত নন। অথচ খাতা সঠিকভাবে মূল্যায়ন নিয়ে অনেক অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার বলে মত দেন এই শিক্ষাবিদ। খাতা মূল্যায়নে উদাসীনতা ও কর্তৃপক্ষের ভুলে পরীক্ষা অনুযায়ী প্রত্যাশিত ফল না হওয়ায় প্রতিবছরই বাড়ছে পুনর্মূল্যায়নের আবেদন। বাংলাদেশ আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটি জানায়, ২০১৪ সালে ফল পুনর্নিরীক্ষণের জন্য আবেদন করেছিল ৪৩ হাজার ২২৫ জন। এক বছরের ব্যবধানে গত বছর সেটি দাঁড়ায় ১ লাখ ২৯ হাজার ৩০১ জনে। এবার ২০১৬ সালে এসএসসির ফল ঘোষণার পর আবেদন পড়েছে ১ লাখ ৭২ হাজার ৬৫৮ জনের। শুধু এসএসসিই নয়, জেএসসি এবং এইচএসসিতেও লাখ লাখ শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছে। গত বছর চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদায় এসএসসি পরীক্ষায় পাস করতে না পেরে ওড়নায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করে সুমি খাতুন (১৬)। মৌলভীবাজারে এসএসসি পরীক্ষায় ফেল করায় সাদিয়া ইসলাম ডানা (১৮) বিষপানে আত্মহত্যা করে। ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায় এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় আত্মহত্যা করে রেণু বালা দাস (১৬)। হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুরে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় পাস করতে না পারায় লিপি দেবনাথ নামের এক ছাত্রী আত্মহত্যা করে। গত তিন বছরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ফল ঘোষণার পর অপ্রত্যাশিত ফলাফলের কারণে গড়ে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

জানা যায়, পুনর্মূল্যায়নে বরিশাল বোর্ডে হিন্দুধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়ে ফেল থেকে পাস করেছে এক হাজার ১৪১ জন। মোট এক হাজার ৯৯৪ শিক্ষার্থীর ফলাফলও বদলে যায়। ফেল করা বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭৯ জন। সার্বিকভাবে জিপিএ-৫ বেড়েছে ১৫টি। বোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অরুণ কুমার গাইন ওই দিন গণমাধ্যমকে জানান, নিজেদের ভুলের কারণে প্রধান দুই পরীক্ষক হিন্দুধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়ে ‘খ’ ও ‘গ’ সেট নৈর্ব্যক্তিক উত্তরপত্র গুলিয়ে ফেলেন। চট্টগ্রাম বোর্ডেও এবার ফল নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে গণিতের ফল নিয়ে শিক্ষার্থীরা সন্তুষ্ট না হয়ে বিক্ষোভ করে। বিক্ষোভের মুখে ১৯ মে নতুন করে ফল প্রকাশ করে বোর্ড। এতে গণিতে জিপিএ-৫ পায় আরও ১ হাজার ১১৫ শিক্ষার্থী। এ ছাড়া সার্বিকভাবে জিপিএ-৫ পায় নতুন ৮৩৬ জন। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাহবুব হাসান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, গণিতের উত্তরপত্র মূল্যায়নে বোর্ডে টেকনিক্যাল ভুল ছিল! শিক্ষা বোর্ড বা কেন্দ্রসচিবের ভুলে বড় অঙ্কের শিক্ষার্থী ফেল করার ঘটনাও বিরল নয়। এ বছর ময়মনসিংহের নান্দাইল পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ১৮ জন ছাত্রী বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। ফলাফলে প্রত্যেকে ৫ থেকে ৭টি বিষয়ে জিপিএ-৫ পেলেও সবাই রসায়নে ফেল করে। এতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে ওই ছাত্রীরা। গোল্ডেন জিপিএ-৫ পাবে এমন শিক্ষার্থীরাও ফেল করায় তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। ভালো ফলের আশায় থাকা অভিভাবকরা এখন সন্তানদের স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকা নিয়ে সংশয়ে দিনাতিপাত করছেন। জানা গেছে, এরা সবাই নান্দাইলের চণ্ডীপাশা সরকারি উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে পরীক্ষা দিয়েছিল। ছাত্রীদের অভিযোগ, রসায়নের নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষায় নির্ধারিত সেট দেওয়া হয়নি তাদের। ‘ক’ সেটের পরিবর্তে তাদের পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে ‘খ’ সেটের প্রশ্নে। এতে অকৃতকার্য হয় সব ছাত্রী। পরীক্ষার পর বিষয়টি টের পেয়ে রাস্তা অবরোধ করেন বিক্ষুব্ধ ছাত্রী ও তাদের অভিভাবকরা। স্কুলটির প্রধান শিক্ষক আবদুল খালেক জানান, এই ছাত্রীরা ফেল করার কথা নয়। তাদের মধ্যে বেশির ভাগ জিপিএ-৫ পাওয়ার কথা। মেয়ে ছয়টি বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে জানিয়ে আজহারুল ইসলাম নামের এক অভিভাবক এ প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ করেন, তার মেয়ে ফেল করার মতো ছাত্রী নয়। কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ অথবা বোর্ড কর্তৃপক্ষের ভুলে এই ১৮ ছাত্রীর জীবন বিপন্ন হতে পারে না। ভোলা জেলার ১৪ শিক্ষার্থী শ্রেণিশিক্ষক নুরুন্নবীর অবহেলায় এ বছরের দাখিল পরীক্ষার অতিরিক্ত বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছে বলে জানা গেছে। তারা বোরহানউদ্দিন উপজেলার টগবী রাস্তার মাথা শরীফিয়া দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। এই শিক্ষার্থীরা সামগ্রিকভাবে উত্তীর্ণ হলেও কাঙ্ক্ষিত ফল থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদের অভিযোগ, অভিযুক্ত শিক্ষক কম্পিউটার বিষয়ের ব্যবহারিক খাতা লেখা ও ভালো মার্ক দেওয়ার আশ্বাসে ৩০০ টাকা করে নেন। কিন্তু ফলাফলে দেখা যায়, সবাই কম্পিউটারে ফেল করেছে। ছাত্র-ছাত্রীরা অভিযোগ করছে, টাকা নিলেও এই শিক্ষক ব্যবহারিক খাতা জমা দেননি। গত বছর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ভুলে যশোর বিসিএমসি কলেজ ও মডেল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ডিপ্লোমা ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পঞ্চম পর্বের দেড়শ শিক্ষার্থী ফেল করেন। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ছিল, তারা সব পরীক্ষায় অংশ নিলেও দুই বিষয়ে ফল যোগ হয়নি। পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে দুটি পরীক্ষায় উপস্থিতির স্বাক্ষরখাতা শিক্ষা বোর্ডে না পাঠানোয় তারা ফেল করেছেন। এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রত্যাশিত ফলাফল না পেলে পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ রয়েছে। মোবাইলের মাধ্যমে একটি মেসেজ পাঠিয়েই তারা পুনরায় খাতা মূল্যায়ন করে নিতে পারেন। তবু আবেগপ্রবণ হয়ে কোনো কোনো শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। এটা অস্বীকার করা যাবে না। তবে এমন প্রতিটি ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তের পরই কারণ জানা যায়। সে মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হয় বলেও দাবি করেন শিক্ষামন্ত্রী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর