রবিবার, ২৯ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা
পর্যবেক্ষণ

বিনাবিচারে আটক বিচার নয়, সন্ত্রাস দমনও নয়

ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন

বিনাবিচারে আটক বিচার নয়, সন্ত্রাস দমনও নয়

পুলিশ সম্পূর্ণভাবে সরকারি রাজনীতির অংশ হওয়ায় তারা যে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না তা কোর্ট আদালতের অজানা নয়। জামিন পাওয়া কঠিন করে এবং গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে পুলিশ রিমান্ডে পাঠিয়ে আসলে যে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করতে সাহায্য করা হচ্ছে সে সম্পর্কে আমাদের সবাইকে সচেতন হওয়ার সময় এসেছে। শত শত লোককে মামলা দিয়ে অপরাধী বানিয়ে আটক রাখা হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণের কোনো চিন্তা নেই।  জামিনও পাবে না। মাসের পর মাস চলছে তাদের বন্দী জীবন। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করার বিশেষ আইনি তাগিদও কোনো কাজে আসছে না।

সন্ত্রাসী কায়দায় খুন-খারাবিও বেড়ে চলেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের উদ্বেগ প্রকাশেও কোনো লাভ হচ্ছে না। সরকার অন্যদের ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে ক্ষান্ত। খুন-খারাবি যেভাবেই ঘটুক ব্যর্থতা তো সরকারেরই। মিথ্যা মামলা দিয়ে সুশীল লোকদের আটক রাখা সমর্থনযোগ্য নয়। সন্ত্রাস দমনের নামে চলছে ভিন্ন ধরনের অমানবিক রাজনীতি। তবুও রাজনীতিতে নতুন চিন্তা-ভাবনার সুযোগ রাখা হচ্ছে না। রাস্তাঘাটে পুলিশের অবস্থান বৃদ্ধি দেখে মনে হয় সম্পূর্ণ দেশটি রক্ষার দায়িত্ব এখন শুধু পুলিশের কাঁধে।

বাংলাদেশে সরকারি পলিসির কারণে উগ্রপন্থা এবং গুপ্তহত্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে উগ্রপন্থার বিস্তার নিয়ে শঙ্কাবোধ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। একজন উচ্চপদস্থ রাষ্ট্রদূত জনাব উইলিয়াম বি মাইলাম, যার প্রাজ্ঞ পলিসি বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিতি রয়েছে, যিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে আমাদের ঘনিষ্ঠভাবে জানার সুযোগ পেয়েছেন, তিনি শুক্রবার নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এই বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন যে, একের পর এক হিংসাত্মক আক্রমণের যে প্রবণতা বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে সেটা যত না শাসন সংক্রান্ত সমস্যা তারচেয়ে বেশি নিরাপত্তা ইস্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত বলে ভুলভাবে দেখা হলে পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটবে। ভারতের সঙ্গে মিলে আমেরিকা যে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় সহযোগিতা জোরদার করার কথা বলছে মাইলাম তার প্রতিবাদ করেছেন।

আমরা বিভিন্ন মন্তব্যের মাধ্যমে সরকারকে সেটাই বলেছি। সরকার সন্ত্রাস দমনের নামে দেশে সন্ত্রাসী তত্পরতা বৃদ্ধিতেই সাহায্য করে চলেছে। সরকার রাজনৈতিক দমন-নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে তার বিজ্ঞ উপদেষ্টাদের নীলনকশা অনুযায়ী। তাদের সহজ বুদ্ধি, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালিয়ে দেশব্যাপী নিরাপত্তাহীনতার অভাবের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে বিরোধিতা করার মতো নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি-বিশ্বাসীদের স্তব্ধ করতে পারলেই হলো। বাস্তবে তো শক্তিশালী সন্ত্রাসী সংগঠন নেই। এদেশে ইসলামী জঙ্গি বাহিনী গড়ে উঠছে এ কথা প্রচার করতে পারলেই বিদেশিরাও সন্ত্রাস দমনে সরকারের সমর্থনে এগিয়ে আসবে। আমাদের চরমপন্থিরা যে বিদেশের জঙ্গি সংগঠনসমূহের সুযোগ নিতে পারে এ ধরনের সম্ভাবনার কথা ভাবার সময় তাদের নেই। আপাতত ক্ষমতায় থাকতে পারলেই হলো। পরে দেশের কী হবে তা তাদের চিন্তার বিষয় নয়। তবুও দেশে সবাই মিলে শান্তিতে থাকার কথা ভাবা যাবে না। 

সত্য-মিথ্যা মামলা দিয়ে মানুষকে আটক রাখার বিষয়টি কোনো ছোটখাটো বিষয় নয়। মানুষের স্বাধীনতা, তার মৌলিক অধিকারসমূহকে গুরুত্বহীন মনে করা হচ্ছে। আমাদের বিচার বিভাগ এ ব্যাপারে উদাসীন থাকতে পারে না। সন্ত্রাস দমনের ক্ষেত্রে সরকারের ভ্রান্ত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত না হওয়ার গুরুত্ব যে কতটা তা প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত মাইলামের বিশ্লেষণ থেকেও উপলব্ধি করা সহজ হবে। সন্ত্রাস দমনে সরকারকে সাহায্য করতে হবে। কিন্তু তাদের দ্রুত বিচার করে দেখাতে হবে সত্যিই তারা সন্ত্রাসী কিনা। বিনা জামিনে আটক রাখার প্রশ্নে বিচার ব্যবস্থা সহযোগী হতে পারে না।

সব ক্ষেত্রে শুনতে চাই না যে, ‘কিছু দিন জেলে থাকুক না’। বিচার বিভাগ পুলিশকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য— পুলিশকে প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য নয়। আইন ও ব্যক্তির অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না থাকলে পুলিশ আর পুলিশ থাকে না। ব্যক্তিগতভাবে আমার কষ্ট হচ্ছে, পুলিশি ক্ষমতার রাজনৈতিক অপব্যবহার দেখে। অথচ তারা জনগণের বন্ধু হিসেবে একটি সুশৃঙ্খল সুন্দর পুলিশ বাহিনীর সুনাম অর্জনের দাবি রাখে। আদালতসমূহকে অধিকতর সতর্ক থাকা একান্ত প্রয়োজন যাতে পুলিশ সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার নাম করে পুলিশি শক্তির অন্যায় প্রয়োগে বিচার বিভাগের সহায়তা না পায়। সরকারি মদদে পুলিশি ক্ষমতার রাজনৈতিক অপব্যবহার যে বেড়েই চলেছে তা আমাদের জজ-বিচারকরা যে জানেন না এমন নয়। বিচারকরা যে-যেভাবেই বিচারক হয়ে থাকুন না কেন তাদের শক্তি জনগণ। জনগণের অধিকার রক্ষার মধ্যেই তাদের মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব। দেশে সন্ত্রাসী তত্পরতার সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে, যার ভয়াবহতা উপেক্ষীয় নয়। 

রাজনৈতিকভাবে পুলিশি ক্ষমতার অপপ্রয়োগ রোধের জন্য পুলিশকে বুঝতে দিতে হবে বিচার বিভাগ তাদের ঊর্ধ্বে আছে। পুলিশ আইন ও বিচার ব্যবস্থার ঊর্ধ্বে নয়। পুলিশও বলে তারা অসহায়। যারা অপরাধ করছে তাদের অনেকেই ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে। অস্ত্র এখন অনেকের হাতেই আছে। মানুষ যাতে অধিকারবিহীন অসহায় হয়ে না পড়ে তা দেখার কঠিন ও পবিত্র দায়িত্ব জজ-বিচারকদের। এ শাসনতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতি দিয়েই তারা বিচারকের সম্মানিত পদ গ্রহণ করেছেন।

হাইকোর্ট ডিভিশন একটি রায়ের অংশ হিসেবে যে ১৫ দফা দিকনির্দেশনা দিয়েছে তা অনুসরণ করা হলে রাজনৈতিকভাবে পুলিশি শক্তির অপব্যবহার এবং সেই সঙ্গে রাজনীতির কারণে বিচার ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে মানুষকে বিনা জামিনে জেলে পাঠানো সহজ হতো না। জিজ্ঞাসাবাদের নামে পুলিশ রিমান্ডের অপব্যবহার বন্ধের জন্য বলা হয়েছে যে, পুলিশ আইনজীবীর উপস্থিতিতে জেল গেটে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। এ রায় নিম্ন আদালতের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে প্রযোজ্য। তবুও মানা হচ্ছিল না। গত মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগও হাইকোর্টের উক্ত রায় বহাল রেখেছে। দেখতে হবে জনগণ এর সুফল কার্যত কতটা পায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয় না, কারণ তাকে পুলিশের বিশেষ সেলে রেখে মামলার বিচার পুলিশি কায়দায় চলবে। বিচার বিভাগের উচ্চতর কর্তৃত্বের কথা পুলিশকে ভাবতে হবে। স্বাধীন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেভাবে সবকিছু মেনে নিচ্ছি তাতে এমনটি হওয়াই স্বাভাবিক। পুলিশের ইচ্ছায় কোর্ট-আদালত চলবে এরূপ আশা করা হচ্ছে। জনগণ প্রদত্ত শাসনতন্ত্রের মূল কথাই হলো জনগণের সার্বভৌমত্ব— জনগণের অসহায়ত্ব নয়। জনগণের পক্ষ সমর্থনে জনগণের সরকার বা জনগণের পুলিশ জনগণকে অসহায় ভাবা হবে কেন? কোনো ব্যক্তিকে জামিন দিলে তিনি তো বিচার থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। কোর্টের সম্মুখে স্বাধীনভাবে আত্মপক্ষ সমর্থনের স্বাধীনতা না দিয়ে মানুষকে জেলে বন্দী রাখার কাজটি সহজ করা স্বাধীন দেশের বিচার ব্যবস্থায় হতে পারে না। 

বলা হচ্ছে, জামিন পাওয়া কঠিন করে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় সুবিচারকেই বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। পুলিশ দিয়ে মিথ্যা মামলা করা সহজ হয়েছে। জামিন না পেলে কার অপরাধের জন্য কাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে তা জানার উপায় নেই। কবে বিচার হবে এবং সত্য জানা যাবে তারও নিশ্চয়তা নেই। বড় বড় অপরাধী রাজনৈতিক আশ্রয়ের সুবিধা গ্রহণ করছে। যে কারণে পুলিশের গ্রেফতারের সংখ্যা বাড়ছে, খুন-খারাবিও বাড়ছে।  বিচার বিভাগের দুর্বলতা ভিন্ন কোনো দেশের মানুষকে অধিকারবিহীন অসহায় করা সম্ভব হয় না। স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় না। সরকারকে এখন রাজনীতিবিদদের ওপর বিনাবিচারে আটক রাখার বিশেষ আইনের প্রয়োগ করতে হচ্ছে না। আমাদের বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক দলসমূহকে দমনের কাজে ব্যবহারের কথা এখন আন্তর্জাতিকভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। আমরা সবদিক দিয়ে নিজেদের অধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হতে পারি না। বিচারে দোষ প্রমাণ করবে আমাদের দক্ষ অপরাধ তদন্তকারী সংস্থাসমূহ। গ্রাম্য কায়দায় নির্যাতন বা নির্যাতনের ভয়ভীতি দেখিয়ে দোষ স্বীকার করানোর জন্য বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের পুলিশের তদন্তকারী সংস্থাসমূহের প্রয়োজন হয় না।  ব্যক্তির মর্যাদা ও অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হতে পারলে স্বাধীনতার অর্জন বলতে কিছু থাকে না। শুধু কর্তাব্যক্তিদের পরিবর্তনের নাম স্বাধীনতা নয়। মানুষের স্বাধীনতাই মৌলিক স্বাধীনতা। কর্তাব্যক্তিদের কর্তৃত্ব স্বাধীনতা নয়।

দেশের শত্রুদের নির্যাতনের জন্য অনেক দেশ মার্কিন গুয়ানতানামো কারাগারের মতো নির্যাতন কেন্দ্র রাখে। এমনকি এরকম কর্মকাণ্ড মানবাধিকারের লঙ্ঘন হিসেবে খোদ আমেরিকায়ও সমালোচিত হয়ে থাকে। কিন্তু সাধারণ ফৌজদারি বিচারের অংশ হিসেবে টর্চার সেলের সমালোচনা আমাদের দেশে করা হয় না।

বিএনপির প্রাক্তন মন্ত্রী-মিনিস্টাররা এখন বুঝছেন যে, পুলিশ রিমান্ড শুধু সাধারণ মানুষের ওপর প্রয়োগ হয় না। তারা এখন অভিজ্ঞতা লাভ করছেন যে, পুলিশ রিমান্ডের মাহাত্ম্য কী। আমাদের শাসনতন্ত্রে নির্যাতন নিষিদ্ধ। এমনকি অভিযুক্তকে অসম্মান ও অপদস্থ করার সুযোগ দেয়নি। তথাপি আমাদের ফৌজদারি বিচার প্রক্রিয়ায় নির্যাতন ব্যবস্থা স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছে।

আমরা যখন শাসনতন্ত্রের পবিত্রতার কথা বলি তখন কিন্তু বিচার ব্যবস্থার পবিত্রতার বিষয়টিকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দিয়ে থাকি। কারণ শাসনতন্ত্র স্বীকৃত অধিকারসমূহের সুরক্ষা দেয় কোর্ট-আদালত। জনগণের কাছে কোর্ট-আদালতই সবচেয়ে বড় ভরসাস্থল।

জনশ্রুতি রয়েছে, যারা পারছে তারা সুপ্রিম কোর্টে জামিনের জন্য আসছে না। যাদের অর্থবল আছে বা রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে তাদের জামিনের জন্য সুপ্রিম কোর্টে আসতে হয় না। তাদের জন্য সবকিছুই সহজ। কিন্তু শেষ ভরসা হিসেবে অসহায় লোকেরাই সুপ্রিম কোর্টের শরণাপন্ন হন, যা তাদের জন্য মোটেও সহজ নয়। 

জামিন সহজলভ্য করার যুক্তি হচ্ছে— জামিন নামঞ্জুর করে অপরাধ কমানো তো  সম্ভব হয়নি। জামিন সহজ করুন, পুলিশ রিমান্ড বন্ধ করুন— দেখবেন অপরাধ হ্রাস পেয়েছে। পুলিশ প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের সম্মুখীন করতে দক্ষতা দেখাতে যত্নবান হবে। মিথ্যা মামলা দেওয়ার জন্য পুলিশকে অসুবিধায় পড়তে হয় না।  অথচ শত শত লোক মিথ্যা মামলায় জেলের মধ্যে ধুঁকছে। তাদের পরিবার-পরিজনের অবস্থা ভেবে দেখা হচ্ছে না।

সন্ত্রাস দমনের অজুহাতে দেশটিকে পুলিশি রাষ্ট্র বানানোর আমলাতান্ত্রিক বুদ্ধি-পরামর্শ বর্জন করার কথাই আমি বলে যাব। পাশাপাশি এটাও বলব যে, বর্তমান সময়ে একদলীয় শাসন নতুন করে প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব।  কোনো ইজমই কাজ করবে না। সন্ত্রাসী শক্তিসমূহকে উৎসাহ জুগিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা যাবে। দেশকে ভয়াবহ খুন-খারাবি ও রক্তপাতের দিকে ঠেলে দেওয়া যাবে। এ ধরনের পথ কারও জন্য নিরাপদ নয়।  একটু বুঝতে চেষ্টা করুন।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।

সর্বশেষ খবর