সোমবার, ৩০ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

মৃত্যুর মিছিলের শেষ নেই

মাহমুদ আজহার

মৃত্যুর মিছিলের শেষ নেই

ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে মৃত্যুর মিছিল বাড়ছেই। এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে ১১৭ জন। নয় বছরের শিশু বাবার হাত ধরে ভোট দেখতে গিয়েও গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে। নারী, বৃদ্ধ ও ফেরিওয়ালাও রয়েছেন নিহতের তালিকায়। রয়েছেন চেয়ারম্যান-মেম্বার প্রার্থীও। ২২ মার্চ প্রথম ধাপ থেকে ক্রমেই সহিংসতা বেড়েছে। পঞ্চম ধাপে ভোটের দিন সবচেয়ে বেশি সহিংসতায় ১৩ জনের প্রাণ হারায়। মৃত্যুর মিছিলে সর্বশেষ যুক্ত হন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের নাজমুল নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মী। ইউপি সদস্য সমর্থক এ যুবক সংঘর্ষে ধাওয়া খেয়ে আহত হন। পরে গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজহাসপাতালে মারা যান নাজমুল। নিহতদের দলীয় পরিচয় বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থক রয়েছেন অন্তত ৬০ জন। এ ছাড়া রয়েছেন বিএনপির ছয়জন, জাতীয় পার্টি-জেপির একজন, জনসংহতি সমিতির একজন, স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থক দুই এবং মেম্বার প্রার্থীর কর্মী সমর্থক ৩৫ জন। সহিংসতায় প্রাণহানির অন্তত ১২ জন রয়েছেন সাধারণ মানুষ। নিহতদের মধ্যে চারজন নারী ও তিনজন শিশুসহ সম্ভাব্য দুজন চেয়ারম্যান প্রার্থী ও তিনজন মেম্বার প্রার্থীও রয়েছেন। চেয়ারম্যান প্রার্থীর মধ্যে ৪২টি সংঘর্ষের ঘটনায় ৪৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এ ছাড়া নির্বাচন-পূর্ব সংঘর্ষে ৪৮ জন, নির্বাচনকালীন সংঘর্ষে ৪০ জন এবং নির্বাচনোত্তর সংঘর্ষে ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। পাঁচ দফার ভোটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে মারা গেছেন অন্তত ২০ জন। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে ঘিরে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই রাজনৈতিক উত্তাপ দেখা যায়। প্রথম ধাপের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২২ মার্চ। বাংলাদেশ প্রতিদিনের নিজস্ব অনুসন্ধান ছাড়াও ইউনিয়ন পরিষদ নিয়ে কাজ করা নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ও ব্রতীর প্রাথমিক প্রতিবেদনে সহিংসতা ও হতাহতের এ চিত্র উঠে এসেছে। স্থানীয় সরকার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ইউপি নির্বাচনে প্রতিটি ঘটনারই সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত। যে বা যারাই দোষী হোন না কেন— তাদের বিচারের আওতায় দাঁড় করাতে হবে। নইলে সামনের সব নির্বাচনেই একই ঘটনার পুনরাবৃতি ঘটবে। বিশ্লেষকদের মতে, পূর্ব শত্রুতার জেরও নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছে। নির্বাচনকে মোক্ষম সময় হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে নির্বাচনী সংস্কৃতি ও গণতন্ত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন বিশ্লেষকরা। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘এবারের নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য ছোলা কেনা-বেচার মতো হয়েছে। কোথাও কোথাও মৃত ব্যক্তিরাও ভোট দিয়েছেন। আমার মতে, নির্বাচনে নিহতরা শহীদ হয়েছেন। এ নির্বাচনকে একটি শহীদি নির্বাচন বলে আখ্যা দেওয়া যায়। নির্বাচন কমিশন অন্তত আর কিছু করতে পারুক বা না পারুক, যারা মারা গেছেন তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করতে পারেন। যদিও এতগুলো মানুষ মারা যাওয়া কোনো খেলা কিংবা তামাশার বিষয় নয়।’ প্রাণহানির ক্ষেত্রে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগেই বেশি মারা গেছেন। এর মধ্যে ঢাকায় এ পর্যন্ত ২০ জন মারা গেছেন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগে ১৯ জন, বরিশাল বিভাগে ১৬ জন, রাজশাহী বিভাগে ১৬ জন, খুলনা বিভাগে ১৬ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ১৪ জন, রংপুর বিভাগে ৫ জন এবং সিলেট বিভাগে ১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। নির্বাচনী সহিংসতায় একজন পুলিশ সদস্যেরও মৃত্যু হয়েছে। তার নাম গোলাম ফারুক। গত ১৮ এপ্রিল রাত ৯টায় নড়াগাতি থানার চরকেকানিয়া এলাকায় আওয়ামী লীগ ফারকান মোল্যা এবং বিদ্রোহী প্রার্থী চুন্নু শেখের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। সেখানে দায়িত্বরত ছিলেন গোলাম ফারুক। দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুরুতর আহত হন ফারুক। ৪০ দিন পরে গত শনিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। অতীতে নির্বাচনের তথ্যসূত্রে জানা যায়, ১৯৭৩, ১৯৭৭, ১৯৮৩ ও ১৯৯২-এ প্রাণহানির কোনো ঘটনা ঘটেনি। ১৯৮৮ সালে ৮০ জন, ১৯৯৭ সালে ৩১ জন, ২০০৩ সালে ২৩ জন এবং ২০১১ সালে ১০ জনের প্রাণহানি ঘটে। অতীতের নির্বাচনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটে ১৯৮৮ সালে। তবে প্রাণহানির ক্ষেত্রে সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে এবারের ইউপি নির্বাচন। এটা পর্যায়ক্রমেই আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। সর্বশেষ পঞ্চম ধাপে নির্বাচনী সহিংসতার জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জেই চারজন, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে দুজন, চট্টগ্রামের পটিয়ায় তিনজন, কুমিল্লার তিতাস, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ এবং পঞ্চগড়ে একজন করে নিহত হন। এর মধ্যে একজন চেয়ারম্যান ও একজন ইউপি সদস্য প্রার্থীও রয়েছেন। এর দুই দিন আগে আরও দুজন নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত হন। এর মধ্যে জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ইউনিয়নে একজন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর এজেন্ট ছিলেন। বাকি তিনজনই আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক বলে এলাকায় পরিচিত। সোনারগাঁয়ের নিহত ব্যক্তিও আওয়ামী লীগ সমর্থক। চট্টগ্রামের পটিয়ায় নিহত তিনজনের মধ্যে একজন ইউপি সদস্য প্রার্থী ছিলেন। বাকি দুজন আওয়ামী লীগের কর্মী সমর্থক। কুমিল্লার বলরামপুর ইউনিয়নের বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী নিহত হন। প্রথম ধাপে ২২ মার্চ ইউপি নির্বাচনের দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার ধানীসাফা ইউনিয়নের পাঁচজন যথাক্রমে মোহাম্মদ সোহেল, শাহাদাত হোসেন, কামরুল মৃধা, বেলাল ও সোলাইমান একসঙ্গে মারা যান। তারা সবাই আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন। একই দিন কক্সবাজারের টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নে দুই ইউপি সদস্যের সংঘর্ষে শফিকুল আলম নামে একজন মারা যান। একই ইউনিয়নে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর ভাই আবদুল গফুর মারা যান। ঝালকাঠি সদরের নবগ্রাম ইউনিয়নে দুই ইউপি সদস্যের সমর্থকদের সংঘর্ষে কাশেম শিকদার নামে একজন মারা যান। সিরাজগঞ্জ সদরের জয়ানপুর ইউনিয়নে দুই ইউপি সদস্যের সমর্থকদের মারামারিতে পদদলিত হয়ে নওনাই বেগম নামে এক মেম্বার প্রার্থীর মা মারা যান। পটুয়াখালীর কালিশুরি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সঙ্গে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংঘর্ষে হুমায়ুন মালিক নামে একজন মারা যান। তিনি বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থক ছিলেন। নেত্রকোনোর খালিয়াজুরি ইউনিয়নে পুলিশের গুলিতে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থীর ভাই আবু কাউসার মারা যান। ৩১ মার্চ দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের দিন কেরানীগঞ্জের হযরতপুর ইউনিয়নে মধুরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের কাছে গুলিবিদ্ধ হয়ে কাজী শুভ নামে এক শিশু মারা যায়। যশোর সদরের চাঁচড়া ইউনিয়নে দুই ইউপি সদস্যের গোলাগুলিতে আবদুস সাত্তার বিশে নামে এক ফেরিওয়ালা নিহত হন। জামালপুরের মেলান্দহে ইউপি সদস্যের হামলায় রকিবুল ইসলাম নামে এক মেম্বারের সমর্থক মারা যান। মানিকগঞ্জের দৌলতপুরের বাঘুটিয়া ইউনিয়নে এক ইউপি সদস্যের বিজয় মিছিল থেকে হামলা করা হয়। এতে নমেছা বেগম নামে পরাজিত প্রার্থীর এক কর্মীর স্ত্রী মারা যান। মাদারীপুর সদরের ধুরইল ইউনিয়নে দুই পক্ষের সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে সুজন মৃধা নামে একজন মারা যান। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের বাউরিয়া ইউনিয়নে দুই ইউপি সদস্যের সমর্থকরা ভোটকেন্দ্র দখলের চেষ্টা চালায়। এ সময় পুলিশ গুলি করলে ঘটনাস্থলেই সানাউল, ইব্রাহিম ও জামাল নামে তিনজন মারা যান। ২৩ এপ্রিল ভোটের দিন পাঁচজনের প্রাণহানি ঘটে। এর মধ্যে পাবনার চাটমোহরে মথুরাপুর ইউনিয়নে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে এমদাদ হোসেন ইন্দা নামে এক সাধারণ ভোটার মারা যান। আওয়ামী লীগ চেয়ারম্যান প্রার্থীর পক্ষে ব্যালট পেপারে সিল মারাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে ইদ্রিস মিয়া নামে একজন সাধারণ ভোটার মারা যান। ফরিদপুরের মধুখালীর বাগাট ইউনিয়নে দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভাই আতিয়ার রহমান খান নিহত হন।

গাজীপুরের শ্রীপুরের মাওনা ইউনিয়নে দুই ইউপি সদস্যের সমর্থকদের সংঘর্ষে পরাজিত মেম্বার প্রার্থীর ভাই আবুল খসরু মারা যান। কিশোরগঞ্জের ভৈরবের শ্রীনগর ইউনিয়নে দুই ইউপি সদস্যের সমর্থকদের সংঘর্ষে সিদ্দিক মিয়া নামে একজন মারা যান।

৭ মে চতুর্থ ধাপের নির্বাচনের দিন মারা যান আটজন। এর মধ্যে রাজশাহীর বাগমারার আউচপাড়া ইউনিয়নে পুলিশের গুলিতে আওয়ামী লীগের দুই কর্মী সিদ্দিকুর রহমান (২৪) ও মুনতাজ (৪২) নিহত হন। নরসিংদীর রায়পুরার পাড়াতলী ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জাকির হোসেনের সমর্থক হোসেন আলী নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর ধাড়ালো অস্ত্রের আঘাতে মারা যান। রায়পুরার শ্রীনগর ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থক আহমদ আলীর ছেলে সুমন মিয়া (৩০) নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে মারা যান। কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নে দুজন ইউপি সদস্য প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় তাপস চন্দ্র দাস (৩২) নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত তাপস চান্দলা গ্রামের কানু চন্দ্র দাসের ছেলে।

ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীর পাড়িয়া ইউনিয়নের কালডাঙ্গা মাদ্রাসা ভোটকেন্দ্রে গতকাল দুপুরে জালভোট দেওয়াকে কেন্দ্র করে তিন ইউপি প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকের সংঘর্ষ চলার সময় গুলিতে এক যুবক নিহত হন। তার নাম মাহবুব আলম (১৮)। তিনি মাছখুড়িয়া গ্রামের আবদুল জব্বারের ছেলে। একই দিন বালিয়াডাঙ্গীর আমজানখোড় ইউনিয়নে দুই ইউপি সদস্যের সমর্থকদের সংঘর্ষে ইটের আঘাতে আছমা বেগম নামে এক নারী নিহত হন। গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরের ধাপেরহাট ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থক লেবু মিয়া (৪০) পুলিশের গুলিতে নিহত হন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর