বুধবার, ১ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

‘মাঝের চর’ ঘিরে এক্সক্লুসিভ ট্যুরিজম জোনের পরিকল্পনা

নিজামুল হক বিপুল

‘মাঝের চর’। ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন-ঘেঁষা বলেশ্বর নদের মধ্যবর্তী একটি চর। নদতীর থেকে কিংবা আকাশ থেকে দেখলে মনে হবে একেবারেই একটি ‘সবুজ দ্বীপ’। উপকূলীয় জেলা পিরোজপুরের জিয়ানগর উপজেলা পার হয়ে বলেশ্বর নদ মাঝের চর দ্বারা দুই ভাগ হয়ে আবারও একই স্রোতোধারায় প্রবাহিত হয়েছে। প্রায় ৬৪০ একর জমির ওপর বলেশ্বর নদের বুকে গড়ে ওঠা মাঝের চর দৈর্ঘ্যে প্রায় ২ দশমিক ৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থ্থে ১ দশমিক ৪ কিলোমিটার। আর সুন্দরবনের তটরেখা থেকে মাঝের চরের দূরত্ব প্রায় ৪ কিলোমিটার। বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়নের তাফালবাড়ী নামক স্থান থেকে নদীপথে মাঝের চরের দূরত্ব এক থেকে দেড় কিলোমিটার। আর পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলা থেকে নদীপথে দূরত্ব ২ থেকে ৩ কিলোমিটার। এ চরের এক অংশ শরণখোলা ও অন্য অংশ মঠবাড়িয়ায় পড়েছে। এই মাঝের চর ঘিরে তৈরি হচ্ছে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। পর্যটনকে অগ্রাধিকার দিয়ে এখানে এক্সক্লুসিভ ইকো ট্যুরিজম পার্ক স্থাপন করা যায় কিনা এর পরিকল্পনা করছে সরকার। ইতিমধ্যে বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দফতর থেকে ইকো ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের বিষয়ে বিভিন্নমুখী সম্ভাবনার বর্ণনা দিয়ে একটি প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যানের কাছে। বেজা কর্তৃপক্ষ চলতি বছরের শুরুর দিকে মাঝের চরসহ আশপাশের আরও কিছু এলাকা নিয়ে একটি এক্সক্লুসিভ ইকো ট্যুরিজম পার্ক করার জন্য মোট ১৫০০ একর জমি চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে একটি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। প্রস্তাবিত এ প্রকল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে বেজা চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা বলেশ্বর নদের মাঝের চরকে ঘিরে একটি এক্সক্লুসিভ ট্যুরিজম জোন করার জন্য চর ও আশপাশের প্রায় ১৫০০ একর এলাকা চেয়ে একটি প্রস্তাব চলতি বছরের শুরুতে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠিয়েছিলাম। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে এ প্রকল্পের বিষয়ে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কাছে মতামত চাওয়া হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে।’ তিনি বলেন, ইতিমধ্যে দুই মন্ত্রণালয়ই তাদের মতামত দিয়েছে। এর মধ্যে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় একটু রক্ষণশীল মতামত দিয়েছে বলে জানা গেছে। পবন চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে বলা হয়েছে ওই মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলতে। শিগগিরই তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবদের নিয়ে বসবেন। এরপর জমির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সম্মতি পাওয়া গেলে চূড়ান্ত প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হবে। এটি ইতিবাচক হবে বলে আশা করেন। স্থানীয়দের তথ্য অনুযায়ী, বলেশ্বর নদের মধ্যবর্তী এই চরটি স্থানীয়রা দেখছেন প্রায় এক শতাব্দী ধরে। উপকূলীয় জেলাগুলোর বিভিন্ন এলাকা থেকে এ চরে এসে লোকজন বসতি স্থাপন করেছে। একসময় এ চরজুড়ে শুধু বালু থাকলেও ৬০-৭০ বছর আগে থেকে এখানে গজিয়েছে ছৈলা, কেওড়াসহ বিভিন্ন জাতের গাছপালা। এ ছাড়া রয়েছে সুন্দরবনের মতোই গুল্ম-লতা আর গোলপাতা। চরটিতে জনমানুষের বসবাসও আছে। সুন্দরবনে, বলেশ্বর নদে ও সাগরে মাছ ধরেন এমন জেলেরা বিভিন্নভাবে এ চর ব্যবহার করে থাকেন। সুন্দরবনের তটরেখার কাছাকাছি হওয়ায় এ বনের অনেক বৈশিষ্ট্যই এ চরে বিদ্যমান। সূত্র জানায়, এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে সুন্দরবন লাগোয়া এই মাঝের চর ঘিরে একটি ইকো ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে আটটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গত বছর ২০ অক্টোবর বাগেরহাট জেলা সফর করেন। তাদের ওই সফরের পরপরই শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ অতুল মণ্ডল মাঝের চর ঘিরে ইকো ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে একটি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পাঠানো ওই প্রকল্প প্রস্তাবে ইকো ট্যুরিজম পার্কের সম্ভাব্য সুফলের বিষয়ে বলা হয়েছে, এটি বাস্তবায়ন করা গেলে জলবায়ুগত পরিবর্তনের প্রভাব এবং মনুষ্যসৃষ্ট সমস্যার হাত থেকে রক্ষা করে সুন্দরবনকে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ফিরিয়ে আনা যাবে।

প্রস্তাবিত ট্যুরিজম পার্কে যা যা থাকবে : ট্যুরিজম পার্কের ভিতর সুন্দরবনের প্রকৃতির সঙ্গে মিল রেখে একতলা হোটেল বা লজ কিংবা কমপ্লেক্স ও একটি কনভেনশন সেন্টার, সুন্দরবনকেন্দ্রিক একটি জাদুঘর ও গবেষণা কেন্দ্র, কাচের স্থাপনার মধ্যে সুন্দরবনের একটি মানচিত্রভিত্তিক মডেল, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গ্যালারি বা সংগ্রহশালা, নৌপুলিশ ফাঁড়ি বা চৌকি কিংবা একটি কোস্টগার্ডের ইউনিট নির্মাণের কথা প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে। আগত অতিথিদের নিরাপত্তা এবং স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে এ কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। শরণখোলা ও আশপাশের উপজেলাগুলোয় অপরিকল্পিতভাবে হোটেল, লজ, পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ কঠোরভাবে দমন করা, সুন্দরবনের বনজ সম্পদের ওপর গবেষণার জন্য একটি ‘জেনেটিক ল্যাব’ নির্মাণের প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

এটি নির্মাণ করা হলে গোলপাতা থেকে ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য রস, চিনি, গুড়, নানা জাতের মাশরুম ইত্যাদিসহ অন্যান্য বিষয়ে গবেষণার সুযোগ তৈরি হবে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রকল্পটির দীর্ঘমেয়াদি টেকসই নিশ্চিত করা গেলে সুন্দরবনকে আদিমতার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে, স্থানীয় অর্থনীতি চাঙা হবে, নিশ্চিত আয়ের সুযোগ সৃষ্টির ফলে সুন্দরবননির্ভর জনগোষ্ঠী আর পুরনো পেশায় ফিরে যাবে না। এসব ছাড়াও সৌরবিদ্যুতের জন্য মাঝের চর হতে পারে আদর্শ স্থান। বছরজুড়ে এখানে সূর্যের আলো থাকে। এ চরে বছরব্যাপী থাকে প্রচণ্ড বাতাস। এগুলোকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।

সর্বশেষ খবর